Your slogan here
Welcome
Here you can
enter your
own text


যেই মাটির ঘরটাতে আমাকে থাকতে দেয়া হয়েছে সেই ঘরের পাশেই পুকুর। জানালা দিয়ে কখনো কখনো পুকুরের পানির আঁশটে গন্ধ নাকে লাগে। আচ্ছা মাছের গন্ধ আঁশটে হয়, তবে আমি কেন বলছি আমার নাকে পুকুরের পানির আঁশটে গন্ধ লাগে? এই গন্ধটা এখন আর আমার ভালো লাগেনা। অথচ একটা সময় শ্বশুরের পুকুরের এই গন্ধটা নেবার জন্যই সন্ধ্যার অন্ধকারে পুকুরের পারে গিয়ে দাঁড়াতাম। বিবাহিত হয়েও স্বামীর ছায়া ছিলনা আমার উপর। যেই মেয়ের স্বামী নিরুদ্দেশ হয় তার বদনামের অন্ত থাকেনা। আর যদি আশেপাশে যুবক বয়সী দেবররা থাকে তাহলেতো কথাই নেই। আজ আমার মেয়ের আসার কথা। আমার চারিত্রিক সনদপত্র নিয়ে। প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসারের সিল, স্বাক্ষর করা আর সবার মতো গতানুগতিক চারিত্রিক সনদপত্র নয়, এটা ডিএনএর টেস্ট রিপোর্ট। আমার মেয়েটা পড়াশুনায় তুখোড়। ওর সবথেকে কাছের বন্ধু ও আমাকেই মনে করে এখন পর্যন্ত। কতো কিছু যে ও আমার সাথে শেয়ার করে তার ইয়ত্তা নেই। শখ ছিল বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে নামের আগে ডক্টরেট তকমাটা লাগাবে। কিন্তু দেশের শুরুটাই বেচারী সঠিকভাবে করতে পারেনি। খুব স্বপ্ন নিয়ে ওর সাবজেক্টের থিসিস কোর্সটা নিয়েছিল। ও তখনও থিসিসের অআকখ কিছুই জানতো না, যদিও তার আগের কোর্সে একটা রিপোর্টে ও ৯০ প্লাস নম্বর পেয়েছিল। কিন্তু ছয়মাস ও শুধু রিসার্চ টাইটেল নিয়েই ঘুরেছে সুপারভাইজারের পেছন পেছন। হতাশার চূড়ান্তে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল...কিন্তু দু-দু'টা দুধের বাচ্চা সামলে, রাতে বাচ্চাদের ঘুম পারিয়ে চোখের জল নিয়মিত লুকাতো আর পড়ায় মন বসাতো। ভাবতো এবার বুঝি ওর ফার্স্টক্লাস নম্বর মিস হয়ে গেল...ওর স্বপ্নের প্লেসটা বুঝি ও আর ধরে রাখতে পারলো না। হয়তো বিবাহিত জীবনের পরাধীনতা থেকেই কীভাবে দাঁত কামড়ে লেগে থাকতে হয় সংসার থেকে শিখে গিয়েছিলো। যেই লেগে থাকা বা স্বপ্ন দেখাটা ওর শৈশব বা কৈশোরে ছিলনা। ও গোয়েন্দা হতে চেয়েছিল। আমি কখনো জোর করিনি ওর ইচ্ছেতে। ও আসলে তখনও শিখেনি সুপারভাইজারের লোলুপ দৃষ্টি সামলে কীভাবে কৌশলে নিজের কাজ উদ্ধার করে নিতে হয়। তাই ছয়মাস পর বাধ্য হয়ে সুপারভাইজারকে বলেছিল 'স্যার, দুই বাচ্চা সামলে থিসিসের কাজ করতে পারছিনা, তাই ছেড়ে দিতে চাই।' আমার কাছে এসে গোপনে কেঁদেছে। শেষ পর্যন্ত ৩০০ নম্বরকে কোরবানি দিয়ে ১০০ নম্বরের প্র্যাক্টিকাম করেছে। হ্যাঁ, সেখানে ফার্স্টক্লাস নম্বর ছিল। কিন্তু মেয়েটা আমার তৃপ্তি পায়নি ডিপার্টমেন্টে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও। কারণ একটাই ...থিসিস ছাড়া ও কোর্স শেষ করেছে। ও এখনও ওর ক্যারিয়ার নিয়ে যুদ্ধ করছে। যুদ্ধ করছে ‘স্বামী’ নামক প্রভুর মন যুগিয়ে ক্যারিয়ার বাঁচাতে। ওর এই সংগ্রাম আমার ভালো লাগে দেখতে। আমি অনেক কিছুই পারিনি। আমি পারিনি নিজেকে পর্যন্ত বাঁচাতে। জীবন দিয়ে একটা ব্যাপার বুঝেছি, মেয়েদেরকে খুব বেশি কৌশলী, চতুর না হলে টিকে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে উঠে। আমি কৌশলী ছিলাম না বরং খুব বেশি বোকা ছিলাম। মানুষকে বিশ্বাস করতাম আরো বেশি। তার খেসারতই এখন আমায় দিতে হচ্ছে এই মাটির ঘরে থেকে। জানিনা জীবনের বাকী সময়টা কেমন করে কাটবে। মাটির ঘরগুলো বেশ পুরনো। এখানে থাকাটা একটু কষ্টকরই বটে। আমার বিছানার একটু পাশেই বৃষ্টির পানি পড়ে ঘর ভেসে যায়। ঘরের বিভিন্ন স্থানে ইঁদুরের গর্তে ভরে গেছে। সেদিন শ্রাবণ মাসের বৃষ্টির পর ঘর থেকে একটা সাপ বেরিয়ে গেছে। আমার করার কিছুই নেই। আমাকে এখানেই থাকতে হবে। পাশেই কয়েকটা পাকা ঘর। সেখানে ছেলে তার সংসার পেতেছে। আমাকে ওরা খাবারে কষ্ট দেয়না। কিন্তু ছেলে নিয়মিত মনে করিয়ে দেয় বন্ধকী জমি ছাড়িয়ে নিতে। আর সাথে এও জানিয়ে দেয় সেখানে মেয়ের কোন হক-দখল নেই। আর মেয়ে কার জন্মের সেটা নিয়েও ছেলের সন্দেহ নয় রীতিমতো সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে সে। কখনো ঝগড়া তুলে মেয়েকে সাফ জানিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনা। বর্তমানে এলাকার চেয়ারম্যান হচ্ছেন আমার মামা শ্বশুর। উনার কাছে কোন সমস্যা নিয়ে গেলে মুখের উপর বলে দেন ‘আপনজনদের জন্যে কিছু করলে বদনাম হবে’। কিন্তু উনারই পরিবারে আমার স্বামীর সম্পত্তি আটকে আছে সেকথা কখনো তুলতে পারিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি এলাকার মেম্বার ছিলেন। বিহারিদের নিরাপত্তার জন্যে মাটির নিচে বাঙ্কার তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মতো নিরাপত্তাহীন ভাগ্নে বউয়ের কথা উনার ভাবনায় আসেনি। কিন্তু এসব কার কাছে বলবো? আর ছেলেতো আমার সাথে সৎবাপের মতো আচরণ করে। ছেলের ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জেই মেয়েটি ডিএনএ টেস্ট করাতে বাধ্য হয়েছে। কখনও খুব নিবিড়ভাবে ও আমায় জিজ্ঞেস করেছে, ‘মা, আব্বাতো আপনাকে সেভাবে ছায়া দিয়ে রাখতে পারেননি। হয়তো সেই দুঃসময়ে, কখনো আপনার দূর্বলতম সময়ে কেউ আপনার কাছ থেকে সুযোগ নিয়েছে। তেমন কিছু হলেও কিন্তু আমার কোন সমস্যা নেই মা। আমি আপনাকে মা ডেকে যেমন বড় হয়েছি তেমনি বাবাকে বাবা জেনেই বেড়ে উঠেছি। এর বাইরেও যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে থাকে আমার দিক থেকে কোন সমস্যা নেই। এসব নিয়ে ভেবে জীবনটাকে দূর্বিষহ করার কোন আগ্রহ আমার নেই।‘ আমি মেয়েকে বলতে পারিনি, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সেই অন্ধকার হয়ে থাকা ইতিহাস। কেবল মলিন হাসি দিয়ে বলেছি, নাহ রে তেমন কিছু ঘটেনি। তুই নিশ্চিন্ত থাক। ও নিশ্চিন্ত থাকতে চেয়েছে। কিন্তু ছেলের সম্পত্তি দরকার। আমাকে নিয়মিত তাগাদা দেয় তাকে লিখে দিতে। ছেলের বউ এই নিয়ে প্রায়ই খোঁটা দেয়। একমাত্র ছেলেকে সম্পত্তি লিখে দিতে আমার এতো সমস্যা কিসের? আমি বউকে বলতে পারিনি আমার সমস্যার কথা। যেই অপবাদে আজ আমার চারিত্রিক সনদ পত্র আসবে সেই একই অপবাদে আর কোন বিশেষ মেয়ের চারিত্রিক সনদপত্র কি আমার ছেলে আনবে? যেই মেয়ের ঔরষে আমারই ছেলের সন্তান রাখতে না পেরে সেই মেয়ে পৃথিবী ছেড়েছে? ছেলে কলেজে পড়ার সময়ই উত্তর পাড়ার এক মেয়ের সাথে দেখতাম খুব ভাব হয়ে গেছে। আমার আপত্তি ছিলো না ওদের সম্পর্কে। ভেবেছিলাম ছেলে একটু রোজগেরে হোক। তারপর দিনক্ষণ দেখে ওর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে বিয়েটা পড়িয়ে দিব। কলেজ পাশ দেবার পর ছেলে যখন সরকারি চাকরির পোস্টিং-এ এলাকা ছাড়লো তার পরপরই মেয়েটা এসে প্রায়ই খুব কাঁদতো আমার কাছে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতো না কেবল অঝোরে কাঁদতো। একদিন ওর এক বান্ধবী বলে দিল সেই ভয়ঙ্কর সত্যি কথাটা যে, কী কারণে ও শুধু বোবার মতো কাঁদে আমার কাছে। ছুটিতে ছেলে যখন বাড়ি এসেছিল তখন ছেলেকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে বিয়ের কথা পারলাম। জানালাম মেয়েটিকে আমার অপছন্দ নয়। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলে মুখের উপর বলে দিল ওই চরিত্রহীন মেয়েকে সে বিয়ে করবে না! আমি বোবা হয়ে গিয়েছিলাম! তাহলে আমার কাছে মেয়েটির কান্না কি মিথ্যে ছিল? অভিনয় ছিল? আমার কাছে এর জবাব নেই। মেয়েটির বান্ধবী দাই দিয়ে লুকিয়ে এ্যাবরশন করালেও শেষ রক্ষা হয়নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে চলে গেছে এই মিথ্যে আশার পৃথিবী থেকে। লজ্জায়, ঘৃণায় আমার গা রিরি করে উঠে। মায়ের উপর এতো বড় অপবাদ ছেলে আমার বিশ্বাস করলো কেমন করে? হয়তো নিজে অভিজ্ঞ বলেই সম্ভব হয়েছে বিশ্বাস করতে। কৈ আমার মেয়েতো বিশ্বাস করেনি কখনো! বরং আমাকে সবসময় বলেছে...’মা, এসব একদম গায়ে মাখবেন না। লোকের মন্দ পুষ্পচন্দ।‘ প্রায় ঘরের পুরুষরাই ঘর ছাড়ছে। কেউ ভয়ে পালাচ্ছে আর কেউবা দেশকে স্বাধীন দেখার আশায় ঘর ছাড়ছে। আমার ঘরের দু'জন পুরুষ দেশকে স্বাধীন দেখতেই ঘর ছেড়েছিল। ছেলেটার তখন কতোই বা বয়স! মেট্রিক পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কে জানতো আমার ছেলে কখনোই মেট্রিক পাশ করতে পারবে না! কখনোই আর আমার বুকে ফিরতে পারবে না! ছোট ছেলেটি তখন নিতান্তই ছোট। স্কুলে যাওয়ার বয়স তখনও হয়নি। মনে আছে নভেম্বরের একরাতে ছেলের বাবা এসেছিল। বলে গিয়েছিল কোন দুশ্চিন্তা না করতে। আর... শেষ আদর করে গিয়েছিল। পরেরবার যখন এসেছিল বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে..হাতে বড় ছেলের রক্তাক্ত জামা-কাপড়। তারপর আর ফেরেনি...। আমার কপাল পুড়েছিল তখনই। আমি জানতেও পারিনি। মামা শ্বশুরের তিন ছেলের দু’জনই বাড়ি ছাড়া। একজন রয়ে গেছে। নিয়মিত আমার খোঁজ খবর রাখতো। কাছের পুরুষ বলতে তখন সেই দেবরই ভরসা ছিল (!)। সবধরনের সহযোগিতা তার কাছ থেকে পেয়েছি। সব পুরুষের ভেতরই হয়তো নারী লোভী একটা সত্তা বাস করে। যাদেরটা প্রকাশ পায়না তাদের বলি ‘ফেরেশতা’ আর যাদেরটা প্রকাশ পেয়ে যায় তাদের আমরা বলি ‘পশু’। আমার দেবরটিকে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কখনো হালকা রসিকতা করতো না তা নয়। গায়ে মাখার প্রয়োজন মনে করিনি। এক সন্ধ্যায় সেই দেবর এসে পাকসেনাদের আর আলবদর বাহিনীদের কাছ থেকে ঘনিয়ে আসা বিপদ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দিয়ে গেল। সাথে এও বললো সম্পত্তি নাকি হাত ছাড়া হয়ে যাবে। যদি বন্ধক দিয়ে রাখি তবে যুদ্ধের সময়ে সেই বন্ধকের টাকা দিয়ে চলতেও পারবো আর যুদ্ধ শেষ হলে তা নিরাপদে ফিরে পাবো নইলে আলবদর বাহিনীর কেউ সম্পত্তির লোভে একা পেয়ে ভিটে ছাড়া করতে পারে। ছেলের বাবা ফিরে এসে যদি না পায়? কোথায় খুঁজবে আমাদের? দেবরের কথায় সেদিন যুক্তি ছিল। ফেলে দেবার মতো মনে হয়নি। সেই-ই ভিটেবাড়ি বন্ধক রাখতে সাহায্য করেছিল। হ্যাঁ, বন্ধকের টাকা যা পেয়েছিলাম তাতে পরের বাড়িতে গিয়ে ঝিগিরি করতে হয়নি, কিন্তু আজীবনের বন্ধকীনামায় আটকে গেছে সেই সম্পত্তি আমার দেবরেরই কাছে। জানতে পেরেছিলাম অনেক পরে, যখন আমার গায়ে অপবাদের বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে। সম্পত্তি বন্ধক নেবার পর এক রাতে দেবর আমাকেও নিতে চেয়েছিল তার শরীরের খোড়াক হিসেবে। ক্লান্ত, বিবর্ণ আমার উপর ঝাঁপিয়ে পরা সেই পশুকে চিনতে আমার কষ্ট হচ্ছিল বড্ড। মেয়ে তখন আমার গর্ভে মাত্রই জানান দিচ্ছে। নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পুরুষাঙ্গে কামড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু দেরী হয়ে গিয়েছিল। যন্ত্রণায় কুকড়ে থাকা চাচার মুখটা দেখতে পায়নি কিন্তু মায়ের বিবস্ত্র অবস্থা দেখে ছোট ছেলে ধরেই নিয়েছিল বাবার অনুপস্থিতিতে মা বুঝি ‘চাচা’ নামের মামাতো দেবরের সাথে লটকে গেছে! টেলিভিশন দেখার সুযোগ তেমন একটা হয়না। ওটা ছেলের শোবার ঘরে রাখা। স্কুল থেকে ফিরে নাতনী এসে আমাকে খবরের কাগজটা দিয়ে যায়। সেখান থেকেই জানতে পারি আজ স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের শাস্তি হিসেবে এর ফাঁসি হয়েছে। কাল ওর ফাঁসি হয়েছে। অনেকদিন পরতো বটেই তারপরওতো বিচার হচ্ছে। বিচারের রায় হচ্ছে আর তা কার্যকরও হচ্ছে। স্বাধীনতা বিরোধী, মানবতা বিরোধীদের অপরাধের শাস্তি হয়। কিন্তু সেই সময়ের দেশপ্রেমী, মুখোশপরা, নারী লোভী পিশাচরা বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছে আমার মতো ভুক্তভোগীদের সামনেই। এদের কোনদিন বিচার হবেনা। আর আমার বন্ধকীনামা হয়তো বিবর্ণ হতে হতে একসময় আমার ছেলের হাতে ঠিকই পৌঁছে যাবে যার প্রয়োজন আমার বা আমার মেয়ের নেই। ১. তিনদিন টানা বৃষ্টির পর আজকের রোদ বড় কাঙ্ক্ষিত, ভালোবাসার। নিজের গুরুত্ব বোঝাতে রোদও যেন আহলাদীপনা করে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ডুবসাঁতার কাটে। বৃষ্টিধোয়া গাছের পাতায় সোনারোদ পিছলে পড়ে পাতার বাহার দ্বিগুণ হয়ে যায়। আমড়া, করমচা, কদম, পেয়ারা, আম, জামসহ নানা জাতের গাছের শোভায় আমোদ আলীর বাড়িটাকে কোনো এক জমিদারের বাগানবাড়ির মতো দেখায়। বিশেষ করে উঠানের করমচা গাছের রূপ এই ভরা বরষায় দেখার মতো হয়েছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে করমচার লাল থোকা আর সাদা ফুলের রূপ দেখে খুব আত্মভোলা মানুষও একবার থমকে দাঁড়াবে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর করে দিবে একবার। যদিও এই বাড়ির কারো কাছেই করমচার আদর-কদর কোনোটাই নেই। অথচ জাহানারার মা ডালে ফোঁড়ন দেবার পর পাঁচ/ছয়টা করমচা দিয়ে ডালে বগল তুলে সেই ডাল দিয়ে দুই থালা ভাত খেয়ে ফেলা যেতো। এই বাড়িতে সেই ডাল রান্না করলে কেউ দাঁতে ভাত কাটবে না। কিন্তু তাই বলে কি আর জাহানারার খাওয়া বন্ধ থাকবে? এক বাটি করমচা ছেঁচে ঘানিভাঙা সরিষার তেল, কাঁচা মরিচ আর সরিষা বাটা দিয়ে ভর্তা বানাতে গিয়ে লবণ চেখে চেখেই ভর্তা অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে জাহানারা। নিজের কাণ্ড দেখে ওর নিজেরই হাসি পায়। ছেলের বউকে হাসতে দেখে উঠানে দাঁড়ানো নিলুফারও হাসে অকারণ। পোয়াতী বউটা শখ করে টক ফল খায়। দেখেই বুকের ভেতর সুখ উথলে ওঠে। এই সময়টাই বেশ, যা দেখো হাসো আবার অল্প কিছুতেই কাঁদো। জাহানারাকে খুশি দেখে নিলুফার আবদার করে, -ও বৌমা, চুলে তেল দিবি না আইজ? মাথাটা উকুনে কুটকুট কইরা খাইতাছে। মরার বিশটির লাইগাতো দাওয়ায় বহি না কয়দিন। ভত্তা খাওন শ্যাষ হইলে তেল আর উকুন মারা চিরুনিটা নিয়া কাছে আয়তো দেহি। অবেলায় অত টক খাইস না। ভাত খাইতে পারবি না। - তোমার মাথা উকুনে খায় না গো মা। পাকা চুলের গোড়াত কুটকুট করে। আইতেছি খাড়াও। পাকা চুল বাইছা দিমুনে। -খবরদার ছেমড়ি, আমার চুল পাকার কথা কইবি না! তোর তন ম্যালা চুল কালা আমার। শাশুড়ির কথা শুনে জাহানারা হাসিতে ভেঙে পড়ে। -হ মা। তুমি তো কচি লাউয়ের ডোগা! মন চায় কচকচ কইরা খাই। -তোর মতো তো কচি শইল আমার! ছেড়ি মুরুব্বি মানে না, যা মন চায় কইয়া ফালায়! নিলুফারের কপট ভর্ৎসনা শুনে জাহানারার হাসি আরো বাড়তে থাকে। হাসির দমকে হাতের তেলের শিশি ছলকে পরনের শাড়িতে খানিকটা তেল পড়ে যায়। তাই দেখে দুজনে আরো হাসে। যেনো এই বাড়িতে একমাত্র হাসিরই সুখরাজ্য। জাহানারার স্বামী ফিরোজ মালয়েশিয়া থাকে। বিয়ের পাঁচ মাসের মধ্যেই ফিরোজকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে জাহানারার শ্বশুর আমোদ আলী। জাহানারার শাশুড়ি ওকে বলেছিল, এটা হলো আমোদ আলীর আরেকটা কূট চাল যাতে ওদের স্বামী-স্ত্রীর নৈকট্য আমোদ আলীকে অসহায় করে না ফেলে। আমোদ আলীর বিধি নিষেধের তর্জনী জাহানারাকে দিন দিন অতিষ্ট করে তুললেও স্বামীর ভিনদেশে থাকা ওকে খুব বেশি কাবু করতে পারেনি। বরং প্রাত্যহিক গৃহস্থালির কাজে ছোটাছুটির ব্যস্ততা আর রাতে ঘুম চেখে স্বামীর রুটিনমাফিক চাহিদা মেটাতে পাঁচ মাসেই জাহানারার হাপ ধরে গিয়েছিল। শরীরের সাথে মনের আকর্ষণের বিযুক্তি দুজনের সম্পর্কের কোনো ইতিবাচক শুরুর ইঙ্গিত বহন করতো না বলে ফিরোজের চলে যাওয়াতেও জাহানারার হাসির খলবলানি বন্ধ হয়নি। তবে জাহানারার এই হাসি ঐশ্বর্যের আরেকটি কারণ হলো শাশুড়ি নিলুফার। প্রিয় সখীর মতো ছায়া সঙ্গী হয়ে যিনি জাহানারার দৈনন্দিন সময়টুকু তরঙ্গময় করে রেখেছেন। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। দুপুরের তেজ মরবার পরের সময়টুকু এভাবেই বউ-শাশুড়ি দুজনে মিলে উপভোগ্য করে তুলছে। গল্পে, কথায়, বুকের ভালোবাসার তোরঙ্গ উপুড় করে দিচ্ছে। ২. মাইকে নিজের নাম শুনে খুব আমোদ লাগে আমোদ আলীর। ওর নামের প্রতিধ্বনিতে কেমন গমগম করে চারপাশ। উপস্থাপক ছেলেটার গলা যেমন ভরাট তেমন দরাজ দিলে বিশেষণ ব্যবহার করেছে। যেসব শুনতেই আমোদ আলীর বুকের ছাতি প্রশস্ত হয়ে যায়। হয়তো সামনে অপেক্ষমান আমজনতাকেও সেই অনুভব স্পর্শ করে তাই বিশিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী মোহাম্মদ আমোদ আলীর নাম ঘোষণার সাথে সাথে অহংকারী করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক। আমোদ আলী বেশিক্ষণ বক্তৃতা দিতে পারেন না। উপস্থিত জনতা ধরে নেয় আবেগে তার কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর একটা সারসংক্ষেপ তিনি মুখস্থ করে রেখেছেন। তবে আজকাল ছেলেপেলে বড্ড বেশি প্রশ্ন করে। প্রশ্ন শোনার সমস্যা হলো, এক প্রশ্নের সাথে অন্য প্রশ্নের উৎপত্তি। আমোদ হাতে রাখা বাদামী ফাইলটা খুলে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নেন সনদটি। লেমিনেটেড সনদটি ফাইল থেকে কেমন ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। যুদ্ধ দিনের বিশেষ বিশেষ বর্ণনা দিতে যেয়ে আজ তার গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। বার বার শব্দবিচ্যুতি ঘটছে। মুক্তিযুদ্ধের বদলে গণ্ডগোল শব্দটা তার জিবের ডগায় এসে গণ্ডগোল পাকাচ্ছে। তবে ফজরের ওয়াক্তেই তিনি বেশ বুঝেছিলেন, দিনটা তার জন্য ভাল হবে না। সকালটা ভাল করে শুরু হয়নি তার। সাতসকালে জাহানারার চোখদুটো কেমন রক্তজবার মতো লাগছিল। তবে এ আর নতুন কী! আমোদ আলীর কোনো মিটিঙের খবর পেলেই জাহানারার চোখজোড়ায় রক্ত এসে জমা হয়। কিন্তু জাহানারার রক্তচক্ষু ছাপিয়ে আজ ইতিহাসের নির্মাণ করা তার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বয়স হচ্ছে তো, আজকাল অনেক কিছুই মনে থাকে না। এইতো আরেকটু হলেই বিশাল একটা ভুল হয়ে যেতো। গ্রামবদলের মতো ব্রিজের নামটাও মুলিপাড়া থেকে কুলিপাড়া হয়ে যাচ্ছিল। আমোদ চারপাশে তাকিয়ে কি যেন খোঁজে। সামনের পরিচিত, অর্ধপরিচিত, অচেনা মুখগুলোর ইতিবাচক দৃষ্টির সামনে নিজেকে তার অসহায় লাগে। আমোদ টের পায় ঝিরিঝিরি বাতাসে স্মৃতির অণুর ভাসে না, ভাসে শুধু ছলচাতুরির শব্দগুচ্ছ। দূর আকাশে কয়েকটি শকুন উড়ছে উদ্দেশ্যহীন। দুপুরের লাজলজ্জাহীন আলোতে ঝলসে যাচ্ছে চারপাশ। নিজেকে সামলে নিয়ে আমোদ বলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। এইবার সব কথার ফুল ওর বুকপকেটে। মাঝে মাঝে গলা কাঁপে। ওঠানামা করে আবেগের তরঙ্গ। এসব ওঠা নামা রপ্ত করেছে বহুবছর হলো। ইতিহাসের সাক্ষী থাকে নাকি বয়সী চুল আর বটের দীর্ঘছায়া। নদীর গতিপথেও নাকি মেখে থাকে ইতিহাসের রঙ। আমোদ এইসব মানে না। আমোদ জানে কুহকের ছন্দে কি করে ইতিহাস রচনা করতে হয়। দুপুরের তপ্ত বাতাস আমোদের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। আর সে আরো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। একসময় স্তোত্রপাঠ শেষ হয়। সম্মাননা স্মারক আর গলায় ফুলের মালা নিয়ে আমোদ স্টেজ থেকে নামে। পিছনে এক মিছিল প্রতারিত মানুষকে ফেলে আমোদ এগিয়ে চলে। সাথে চলে কয়েকজন অন্ধ অনুগামী। সরষে খেত ঘেঁষে আমোদ হাঁটে। পাকুরিয়া ময়দান থেকে তার বাড়ি দুই কিলো হাঁটা রাস্তা। দুটো ছেলে ছাতা ধরে আমোদের পাশাপাশি হাঁটে। এদের সাথে আমোদের কথোপকথন বড় সাবধানী। আজকাল এত সতর্কতা ভাল লাগে না। বয়স বাহাত্তর ছুঁয়েছে। স্থানবদলে খানিক নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। কিন্তু গ্রামের প্রভাব প্রতিপত্তি রেখে শহরে যেতেও মন টানে না আর। ছেলেটাকে বিদেশ পাঠিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেও, ছেলে বউ জাহানারার বেয়াড়াপনা আজকাল সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাড়িতে পা দিলেই দেখা যায় পর্দাপুশিদার বালাই নাই, মাথার কাপড় নাই। এক একজন বাজারি মেয়েমানুষের মতো হাসিতে ঢলে ঢলে পড়ছে। আমোদ আলী খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। খেতের ভেতর থেকে ঘুঘুর আর্তনাদ শোনা যায়। রাখাল বালকের পেতে রাখা ফাঁদে থেকে আসছে সেই করুণ সুর। রোজ ভোরে খেতে নামে ঘুঘু। ফাঁদে অসর্তক পা ফেলার সাথে সাথে জালবন্দী হয়ে যায় দু একটি পাখি। আমোদ দূরে তাকায়। দুষ্ট রাখাল বালকের ফন্দি আঁচ করতে পেরে সরলরেখায় উড়ে বেড়াচ্ছে পরিযায়ী পাখির দল। ঐ যে দূরে রুপালি-ধূসর ডানার রুপাচিল। খেতের কোল ঘেঁষে বারকতক খেলনা বিমানের মতো শো শো করে উড়ে যায়, তবু হলদে জমিনের লোভে পড়ে না। পাখিটা ফাঁদে পা দেয় না। বেঁচে যায়। কী শান্তি! কী শান্তি! আমোদের মন বিস্তীর্ণ প্রশান্তিতে ভেসে যায়। ৩. ফুলেরা যখন পরিণতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে তখন তাদের যেমন মলিন ও বিধ্বস্ত দেখায় জাহানারাকেও তেমন দেখাচ্ছে। আমোদ আলীর তবু দয়া হয় না জাহানারাকে দেখে। বরং জাহানারার মলিন জবুথবু মুখটা দেখে ওর মনে জ্বলে ওঠে আগুনের ফুলকি। এবার আমোদ এমন ভাবে জাহানারাকে মারে যেন জাহানারার কোনো শরীর নেই। চ্যালা কাঠটির ক্রমাগত আবর্তনে জাহানারার মাঝবয়সী শরীরে দাগ বসে যায় তবু যেন ব্যথা লাগে না। জাহানারার স্তব্ধতায় মনে হয় তার জাগতিক বোধসমূহ হওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তবু ধরা দিচ্ছে না জাহানারা। একটিবারের জন্যও সৃষ্টিকর্তাকে বা আমোদকে বলছে না, আমাকে ছাড়েন! রহম করেন! আমোদ আলী আর জাহানারার চোখের দৃষ্টিতে আগুন ঘোরপাক খায়। সেই সাথে দুটি মানুষের বিপরীতমুখী অন্তর্জগত আর বর্হিজগতের ইতিহাস মুদ্রিত হতে থাকে বাতাসের সমুদ্রে। সেই সমুদ্রের ঢেউ আচমকা আছড়ে পড়ে জাহানারার মুখে, চোখে, চিবুকে। জাহানারা এবার ফুসে ওঠে। -ওই হারামি! জাহানারার স্পর্ধা দেখে আমোদ আলীর ইচ্ছে হয় আরেকটা চ্যালা কাঠ ভাঙে বেটির শরীরে, বেপদ্দা, বেলেহাজ! আকাইম্মা মাগী! কিন্তু আমোদের দু’হাত সক্রিয় হওয়ার আগেই নিলুফারের দুই হাত তার পা জড়িয়ে ধরে, -বৌমারে ছাইড়া দ্যান। আমরা থাকুম না। এই ভিটা ছাইড়া বৌমারে লইয়া যামুগা। নরম শরীর, ম্যায়াডা বাঁচবো না। এমনেই ছাওয়ালডা দুনিয়ায় আইসাও মইরা গেল। সেই শোকে ম্যায়াডার মাথার ঠিক নাই। আমোদ আলী গর্জে ওঠে, -যা মাগী....তুই যা। তোর বৌমারে আমি এহানেই পুতমু। পাড়ার পোলাগো লগে গুজুর গুজুর। আমারে ইতিহাস শিখায়! সাম্বাদিক শিখায়! হঠাৎ জাহানারার কি হয়। হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ায়। যেন খুব জরুরি কিছু একটা মনে পড়েছে। এক ছুটে জাহানারা রান্নাঘরে যায়। বটি হাতে রক্তচোখে জাহানারা গর্জে ওঠে, -মা কোনোখানে যাইবো না, আমিও যামু না। তুই যাবি রাজাকার, বেজন্মার বাচ্চা। তোর চক্ষু দুইটা খুইল্লা ফালামু আজ। হারামি। রাজাকার! জাহানারা ক্রমাগত জগতের সব নোংরা শব্দের বিশুদ্ধ ব্যবহার করতে থাকে। সেই শব্দযজ্ঞে বিপন্ন আমোদ পালাবার পথ পায় না। বাতাসের ঘূর্নিতে শব্দ গুচ্ছ পাক খেতে থাকে। আর আমোদ আলীকে সেই ঘূর্নি থেকে বের হবার পথ করে দেয় না। অদূরে দাঁড়ানো নিলুফার থরথর করে কাঁপে। ভয়ে। আশংকায়। জাহানারার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে আমোদ। দুই পা ধরতে খানিক ইতস্ততঃ করে আবার হাত বাড়ায়। জাহানারার হাতে ধরা বটিতে রোদের আলো পিছলে যায়। -রাজাকারের বাচ্চা! মুক্তিযোদ্ধা হইছস! ভেক ধরস। আইজ তোর ভেক ছুটামু। হারামি রাজাকার! শরীরের সব ঘৃণা নিংড়ে জাহানারা গালি দিতে থাকে। গালির পুনরাবৃত্তিতে শব্দটার অন্তর্গত ঘৃণা যেন ওর মস্তিস্কের গোপন কুঠুরিতে বিরতীহীন আঘাত করতে থাকে। এই জাহানারা যেন সবার অচেনা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আসন্ন প্রেক্ষাপটের ভয়াবহতা যেন তার কাছে দৃশ্যমান হয়ে যায়। দুনিয়াদারির ঝাপসা আবছায়া থেকে যেন টেনে হিঁচড়ে ইতিহাস বের করে আনবে জাহানারা। বাতাসের ছুরিতে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিবে আমোদের নিজ হাতে তৈরি ইতিহাস। -হারামি রাজাকার, গেরামথন পলাইয়া গেছিলি। মুক্তিগো দাবড়ানি খাইয়া ঠ্যাং ভাঙছোস! এহন ন্যাতা হইছোস রাজাকারের রাজাকার! হঠাৎ থেমে যায় জাহানারা। যেন বিদ্যুত চলে যাওয়ায় টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। চারপাশ সুনসান। আঁচলের খুট থেকে চাবির গোছা বের করে জাহানারা ভেতর ঘরে পা বাড়ায়। নিলুফার চমকে পিছু ডাকে, জানারা, জানারা! কিন্তু সেই নিস্প্রাণ কণ্ঠস্বর দ্রুত বাতাসে হারিয়ে যায়। আমোদের দিশেহারা লাগে। কী হলো! কী হবে! জাহানারার এই রূপ আমোদ, নিলুফার কখনো দেখেনি। পাকঘর আর কলঘরের বৃত্ত ডিঙিয়ে নিলুফার কখনো দু’পা সামনে দেয়নি। গ্রীবা উঁচু করে কথা বলেনি আমোদের সাথে। এত বছরের সংসার জীবনে নিলুফারের সমান্তরাল আচরণের বিপরীত প্রতিমূর্তি আজ আমোদের সামনে দাঁড়ানো। আমোদ আলীর পা সরে না। ঘরের ভেতরের রহস্যময়তা ভাঙার কোনো তোড়জোড় দেখা যায় না তার মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহানারা বের হয়ে আসে। এলোকেশে জাহানারাকে ঝড়ের মতো দেখায়। ওর হাতের সবুজ রঙের ফাইলটি দেখে আমোদ আলী গর্জে ওঠার শেষ চেষ্টা করে। ফাইলের ভেতরে কত সযতনে রাখা আমোদের লেমিনেটেড সনদ। ফাইলটি নিয়ে জাহানারা চুলার পাড়ে যেয়ে বসে। ওর চোখে মুখে কোমল অহংকার। বোধ বিলুপ্ত আমোদ মুহুর্তেই বুঝে যায় কি ঘটছে যাচ্ছে। তার ইচ্ছে হয় ছুটে যায়। কিন্তু কী অদ্ভুত ভাবে আমোদের দুই পা চোরাবালিতে গেঁথে যায়। কুলকিনারাহীন বিহ্বলতায় আমোদ শক্তিহীন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। তবু শেষ চেষ্টা করে সে। এবার ছুটে যাওয়ার বদলে হাঁটার চেষ্টা করে আমোদ। কিন্তু ততক্ষণে ধানের সবুজ ঘ্রাণে একাকার ফসলী মাঠের সুবাসের সাথে বাতাসের ঘূর্ণিতে নিবিড় ভাবে প্লাস্টিক পোড়া গন্ধ জুড়ে যায়। দীপ্তিময় হলুদে ছাওয়া হিজল গাছটার দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মতি। গাছটার যেনো প্রাণ আছে, ফুলের সোন্দর্য দিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে। মতি চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে গাছটার দিকেই তাকিয়ে থাকে। তার কোনো তাড়া নেই, অঢেল সময় নিয়ে চা খেতে পারে। বাজারে ভিড় বাড়ছে। রহমতের চায়ের দোকানেও বেশ ভিড়। মতি চারপাশের মানুষগুলোকে দেখে, তাদের জীবনে কত রকম সমস্যা! সবচেয়ে বড় সমস্যা টাকার। বেশির ভাগ মানুষ অভাবী। তারা তাদের দৈনন্দিন ছোটখাট সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা করতে পারে। মতি মনে মনে খুব হাসে। তার মনের ভেতর একটা খোলা ময়দান, সেখানে টাকা লাগে না। মতি সেখানে মহারাজা। রহমতের দোকনের সামনেই আলমের টিনের দোকান। দোকানের সামনে একটা ছোট ট্রাক দাড়িয়ে আছে। আলম দোকান থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছে। দোকানে আনিস কাজ করে, আজকে আসেনি, তার নাকি পেট খারাপ। ট্রাক থেকে টিন নামানো দরকার। হঠাৎ মতিকে দেখে ডাকে আলম। মতি একচুমুকে চা শেষ করে পকেট থেকে ময়লা একটা দুই টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় রহমতের দিকে। রহমত খেকিয়ে উঠে, ' দুইকাপ চা, ছয় ট্যাকা, দুই ট্যাকা দিয়া কই যাস?' মতি গা করে না , আলমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। 'মতি, আছস কেমন?' মতি ঘাড় নেড়ে হাসে। 'মাথা ঠান্ডা আছে তো?' 'মাথা বরফ ঠান্ডা।' আলম চোখ কুঁচকে তাকায়। মতি এমনিতে ভালই কাজ করে, গায়ে গতরে শক্ত আছে। কিন্তু মাথার সমস্যাটাই ভয়ের। হুটহাট তার মাথা গরম হয়ে যায়, তখন মতি কোনো কিছুর পরোয়া করে না। যাকে খুশি মারধর করে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে গালি দেয়, পাগলা ঘোড়ার মতো মাটিতে লাথি দিতে থাকে, যেন সব রাগ ক্ষোভ ওই মাটির প্রতি। মতিকে বাজারে সব সময় দেখা যায় না, মাঝে মাঝে তার মর্জি হলে আসে। যখন আসে, আলম তখন মতিকে দিয়ে পঞ্চাশ টাকার কাজ দশ টাকায় করিয়ে নেয়। আলমের কথা মত ট্রাক থেকে টিন নামিয়ে রাখে মতি। কাজ শেষে আলমের সামনে আবার এসে দাঁড়ায়। আলম দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয়। মতি কেমন চুপ করে থাকে, হাত বাড়িয়ে নোটটা নেয় না। 'কিরে, ট্যাকা নে।' 'ট্যাকা লাগত না, ভাত খামু।' 'আরে কয় কি? ভাত কই থেইকা দিমু?' 'চাইর দিন ধইরা খালি মুড়ি খাই, ভাত খাইতে মন চাইতেছে, কাঁচা মরিচ দিয়া গরম ভাত।' আলম থম ধরে তাকিয়ে থাকে, মহা মুশকিল দেখি!এখন ভাত কোথায় পাবে? আবার ভাত না দিলে পাগলের মাথা গরম হতেও পারে। একবার মতির পাগলামি দেখেছে আলম। সেই ভয়াবহ দৃশ্য আর দেখতে চায় না। 'আইচ্ছা, দুইফরে বাড়িত খাইতে যামু, তুই আমার লগে যাইস।' মতি দোকানের সামনে বেঞ্চে গিয়ে বসে। আবার আশেপাশের লোকগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়। আলম খেয়াল করে মতি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে আর মুখ টিপে হাসছে। তার চোখ উদ্ভ্রান্ত। মতির পরনে রং জ্বলা চেক লুঙ্গি আর ময়লা ধুসর রঙের শার্ট। কে যানে, শার্টটা হয়ত কোনদিন সাদা ছিল, এখন তার উপর ধূলোর আস্তরণ। মাথার চুলে নির্ঘাত জট পাকিয়ে আছে। রোদে ঝলসানো অকালে বলিরেখা পড়া রুক্ষ চামড়া। অথচ চোখ দুটো অম্লান উজ্জ্বল! এই বাজারেই মতির মনোহারি দোকান ছিল। তেল,সাবান ,নারিকেলের বিস্কুট, আচার আরো কত কি পাওয়া যেতো। সব সময় ভীড় লেগেই থাকত। আলম নিজেই তো কতদিন মতির দোকান থেকে সদাই কিনেছে। ভাতের অপেক্ষা করতে করতে মতি যখন প্রায় ঝিমিয়ে পরছিল তখন আলম তাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল। বাজারের পেছনে ঢালু জমি পেরুলেই গ্রামের ভেতর যাওয়ার রাস্তা। মতি ভাবুক চোখে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। আগুন লাগা লাল ফুলে ছেয়ে আছে গাছটা। এই ফুলগুলো শাহিনার খুব পছন্দ ছিলো। একবার আবদার করলো ঠিক এই ফুলের মত লাল একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে তাকে। মতি গাছ থেকে ফুল ছিড়ে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল শাড়ির দোকানে। সাথে তার বন্ধু কামালও গিয়েছিলো, কত হাসলো তার কান্ড দেখে! 'কিরে, দাঁড়ায় গেলি ক্যান? তাড়াতাড়ি আয়।' আলমের তাড়ায় মতি আবার হাঁটতে থাকে। 'মতি, তোর মাথা তো এখন ঠান্ডাই থাকে। দোকান আবার দিবি নাকি?' আলমের উপহাস মতির গায়ে লাগে না। মতির দুঃসময়ে আলম কম দামে দোকানটা কিনে নিয়েছে। এখন দোকান চালায় তার ছোট ভাই। মতির ছোট দোকান এখন অনেক বড় হয়েছে। চারজন কাজ করে। মতি মাঝে মাঝে দূর থেকে দোকানটার দিকে তাকিয়ে দেখে, মাথার ভেতরটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়, কেমন যেন অস্থির লাগে। আলমের বৈঠক খানায় খাবার দিয়েছে আলমের বউ। একটা ছোট কাজের মেয়ে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। আলমের বৌএর মাথায় লম্বা ঘোমটা, গাড়ো সবুজ শাড়ির ফাঁকে চিকন দুইটা সোনার চুড়ি ফর্সা হাতে কি সুন্দর দেখা যাচ্ছে, মতি আগ্রহ নিয়ে ফর্সা হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। শাহিনার খুব শখ ছিলো সোনার চুড়ি পরার কিন্তু মতির স্বাধ্য ছিল না। একবার হাটে এক ফেরিওয়ালা চুড়ি বিক্রি করতে আসলো। বাজারে সেই চুড়ি নাকি নতুন এসেছে, শুধু মাত্র ঢাকায় পাওয়া যায়। ফেরিওয়ালা ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছে। সেই চুরি দেখলে নাকি স্বর্ণকারও ধোঁকা খেয়ে যাবে। ফেরিওয়ালা ইনিয়ে বিনিয়ে কত ভালো ভালো কথাই না বললো চুড়ি নিয়ে, 'এই চুড়ি নিয়া আপনার ইস্তিরির হাতে পরায় দিয়া বলবেন, স্বর্ণের চুড়ি। জীবনেও বুঝতো না এইটা ইমিটেশন। সারাজীবন চুড়ি পিন্দা গোসল করলেও চুরির রং যাইবো না। গেরান্টি দিতাছি, আমি কিন্তু মিছা কইয়া ব্যবসা করি না।' মতি দুইটা চুড়ি কিনেই ফেললো। রাতে ঘরে ফিরে হাতে পরিয়ে দিতেই ঝলমল করে উঠলো শাহিনা। 'ওমা, স্বর্ণের চুরি ক্যামনে পাইলেন ? কই থেইকা কিনলেন? অনেক ট্যাকা লাগছে না?' আনন্দে চিকচিক করা শাহিনার চোখের দিকে তাকিয়ে মতি মিথ্যা বলতে পারে না। নিচু গলায় বলে 'স্বর্ণের চুড়ি না বউ, ইমিটেশন।' 'কি কন? আপনে না কইলে তো আমি বুঝতামই না।' 'তোমারে স্বর্ণের চুড়ি দিতে পারলাম না, দিলাম ইমিটেশন।' মতির কথায় মুখ চেপে হেসে ফেলে শাহিনা। দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে মতিকে। 'স্বর্ণের চুড়ি না তো কি হইছে? এই চুড়ি দুইটা অনেক সুন্দর। আপনে মন খারাপ করেন কেন?' সেই মুহুর্তের বিন্দু বিন্দু সুখ প্রবল শক্তিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মতিকে। শাহিনার চুলে তেলের গন্ধ, জংলা ছাপের শাড়ি, দুগছা চুড়ির টুংটাং শব্দ; এমন আরো কত কিছু যে ভুলতে চায় মতি কিন্তু ভুলতে পারে না। আলমের ডাকে চমকে উঠে মতি। 'কি মিয়া, খাওয়া থুইয়া কি ভাবতাছো?' 'খাইতে মন চাইতেছে না, আইজকা যাইগা।' 'আরে মিয়া বসো, তোমার লগে কথা আছে। ' আলম মতির হাত টেনে বসিয়ে দেয়। 'মতি, তোমারে কিছু কথা কই, শুনো। মাথা গরম করবা না। তুমি যে এই রকম পাগল হইয়া ঘুরতেছ, কোনো লাভ হইতেছে? দোকানটা হাত ছাড়া করলা, ঘরে দানা পানি থাকে না, এইখনে যেইখানে ঘুইরা বেড়াও। মাইনষে তোমারে পাগল কয়। আর ওইদিকে শাহিনা আরেকজনরে বিয়া কইরা ভালোই আছে । এইতো কয়দিন আগে জামিনপুরের পীর সাহেবের ওরশে শাহিনা তার স্বামীকে নিয়া আসছিলো। তার স্বামীর সাথে কথা বইলা বুঝছি, ভালো টাকা পয়সাওলা। শাহিনার কাপড়-চোপড় গয়না দেইখা বুঝা গেল সে ভালই আছে। তোমার কথা একবারও জিগায় নাই। অবশ্য স্বামীর সামনে ক্যামনে জিগাইবো? তবে শাহিনা অনেক ভালো আছে। আর তুমি এইখনে কি করতেছ? যার জন্য পাগল হইয়া ঘুরতেছ, তারতো তোমার জন্য কোনো চিন্তা নাই।' মতির ভেতর আগুন ফুসে উঠে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আলমের দিতে তাকিয়ে হাতের প্লেট ছুড়ে মারে। প্লেট ভাঙ্গার শব্দ শুনে আলমের স্ত্রী ভেতর থেকে ছুটে আসে। 'ভাত খাওয়াইতে নিয়া আইসা প্যাচাল পারস ক্যান?' মতি একগাদা গালিগালাজ করে হনহন করে বের হয়ে যায়। মতি বাড়িতে ফিরে দরজা বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে পরে। কে যেনো তাকে পরামর্শ দিয়েছিল বেশি রাগ উঠলে চুপচাপ সোজা হয়ে শুয়ে পড়তে। মতি একদৃষ্টিতে ঘরের চালের দিয়ে তাকিয়ে থাকে। মতি এমনিতে ঘরের দরজা জানলা সবসময় বন্ধ রাখে তাই ঘরে কেমন একটা বদ্ধ গুমোট ভাব। এর মাঝে চালে কয়েকটা ফুটো গলে তীক্ষ্ণ আলোর রেখা ঘরে ঢুকে কেমন যেন রহস্য তৈরী করেছে। মতির মাথায় আগুনের ফুলকিগুলো শান্ত হয়েছে। যে তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল সটান শুয়ে পড়লে রাগ কমে যায়, বুদ্ধিটা ভালই দিয়েছে। মতির এক দুসম্পর্কের মামা শাহিনার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলেন। মতির বাবা মা কেউ নেই। নানা সংকট ঘিরে থাকলেও মতি পরিশ্রম করতে পারতো। বাজারে দোকানটাও ভালই চলছিল। শাহিনার বাবা মা এতিম ছেলের সাথে বিয়ে নিয়ে নিম রাজি ছিলো, তারপর কিভাবে জানি বিয়ে হয়ে গেল মতিউর আর শাহিনার। বিয়ের দিনটার কথা খুব মনে পরে মতির। কেমন যেন ভয় আনন্দ মেশানো অনুভুতি। নিজের মায়ের মুখটা আবছা আবছা মনে পরলেও বাবার কথা কিছুই মনে নেই মতির। অন্যমানুষের ভরা সংসার দেখলে নিজের বুকটা এমন খাখা করত, শাহিনাকে দেখে মনে হলো সব শুন্যতা পূরণ হয়ে গেছে। খালি মনে হলো এই মেয়েটাকে সে কোনদিন কোনো কষ্ট দেবে না। মতি চোখ বন্ধ করলে এখনো সব দেখতে পায়। তাদের সংসারে ভালবাসার কোনো শেষ ছিল না। দিনশেষে বাড়ি ফেরার তাড়া আর অপেক্ষায় বসে থাকা শাহিনার মুখটা মতিকে উজ্জীবিত করতো । মাঝেমাঝেই এটা সেটা নিয়ে যেত শাহিনার জন্য, একটু কদমা, চুলের ক্লিপ কিংবা সাবান। শাহিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত আর তারপর হেসে লাজুক গলায় বলতো 'কি সব ছাতা মাথা কিন্না পয়শা নষ্ট করেন?' আচ্ছা, শাহিনার কি সেসব কিছুই মনে পরে না? সব ভুলে গেছে? যেদিন তাদের ছেলে বাবলু জন্মালো, মতি পাগলের মত কেঁদেছিল। আশেপাশের বাড়ির লোকজন তার কান্ড দেখে হেসে বাঁচে না ! বাবলুকে কোলে নিয়ে মতির মনে হয়েছিলো পৃথিবীতে এর চেয়ে বেশি আর কিছু চাওয়ার নেই তার। যতটুকু পাওয়ার কথা ছিল তারচেয়ে অনেক বেশি সুখ তার কোল জুড়ে ঝলমল করছে। আবছা অন্ধকার ঘরে আলোর রেখাগুলো কেমন যেন এক বিচিত্র নকশা তৈরী করেছে। বাবলু কি পানিতে ডোবার সময় আলো দেখেছিল? ওইতো সেদিন মতি দোকানে কাজ করছিল, কে যেনো দৌড়ে এসে জানালো বাবলু পুকুরে পরেছে। ছুটে এসে বাড়ির উঠানে বাবলুর লাশ দেখে মতির মনে হয়েছিল পুরো ব্যাপারটাই বানানো -মিথ্যা। সে অবাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে ছিল। শাহীনা আছড়ে পরে কাঁদছিল , তাতে যেন মতির কিছু যায় আসে না। তার শুধু মনে হয় বাবলু কিছুতেই পানিতে নামতে পারে না। কতবার বাবলুকে গল্প শুনিয়েছে,' ওই পুষ্কুনির তলে কিন্তু রাক্ষস আছে , তুমি কিন্তু কোনদিন ওই পানিতে যাইবা না। ঠিক আছে বাপ ?' বাবলু কি সুন্দর ঘাড় কাত করে সায় দিত, সে কখনো যাবে না। তাহলে কিভাবে গেলো ? বাবলুর লাশটা দেখে মনে হচ্ছিল এক্ষুনি উঠে বসবে। মতি কত ডাকলো, বাবলু উঠেনি। বেশিরভাগ সময় মতি পুকুরের পাড়ে বসে থাকতো। তার মনে হত যেকোনো সময় বাবলুকে দেখা যাবে। হঠাৎ হঠাৎ পানিতে নেমে পাগলের মত আঘাত করত পানিতে, যেন অদৃশ্য রাক্ষসটাকে মারছে। কত কষ্ট হয়েছে বাবলুর! হাত পা ছুড়ে চিৎকার করে বাবাকে ডেকেছে, মতি শুনতে পায়নি। তিন বছরের বাবলুর ছোট্ট বুকে পানি ঢুকেছে, বাবলু নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, বাঁচার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছটফট করেছে কিন্তু মতি কিছুই করতে পারেনি। সেই হতাশা আগুনের মত পোঁড়ায় মতিকে। শাহিনার মনে হয় মতিউর থেকে ধীরে ধীরে মতি পাগলা হয়ে যাওয়া মানুষটার সাথে তার যোজন দুরত্ব। হাত বাড়ালেই মানুষটাকে আর পাওয়া যায়না। মতির নিচ্ছিদ্র বলয়ে শাহিনার কোনো স্থান নেই। প্রায় বছর ঘুরে গেলেও মতি শাহিনার সাথে ঠিক মতো কথাও বলে না। মাঝে মাঝে মতিকে ভয় হয় , লোকটা কেমন বদলে গেছে, শত চেষ্টা করেও লোকটাকে কাছে আনতে পারে না। মতির মনে আছে সে রাতের কথা। শাহিনা তার পাশে শুয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, আদর সোহাগ চায়। মতির হঠাৎ কি যেনো হয়, এক ঝটকায় শাহিনাকে বিছানা থেকে ফেলে দেয়। তারপর হিসহিস করে বলে, 'কেমন মা তুমি? তোমার পোলা মইরা গেছে, আর তুমি আমার সাথে সোহাগ করতে আসছো ? তুমি মা, নাকি রাক্ষসী?' শাহিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিচু গলায় বলে, 'আমার কি দোষ?' মতি চিৎকার করে উঠে, 'সব দোষ তোর। একটা মাত্র পোলা তুই দেইখা রাখতে পারলি না? তুই মারছোস আমার পোলারে.................’ হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে মারতে থাকে শাহিনার দিকে। আতঙ্কে কাঁদতে থাকে শাহিনা। তারপর চুলের মুঠি ধরে এলোপাথারি মারতে মারতে ঘরে থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে । তাদের চিৎকারে আশেপাশের বাড়ির মানুষজন চলে আসল। সবার সামনেই মতি বললো ,' তোর চেহারা আমি দেখতে চাইনা আর। চইলা যা তুই, এক্ষণ চইলা যা। ' শাহিনা সে রাতেই চলে গেলো। আর ফিরে আসল না। মতির অনেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হয়েছে দরজা খুললেই দেখবে শাহিনা উঠানে মুরগিগুলোকে ধান ছিটিয়ে দিচ্ছে। কখনো নির্ঘুম রাত শাহিনার সাথে একা একা গল্প করেছে , ফিস ফিস করে বলেছে, 'আমার ভুল হইছে, তুমি চইলা আসো।' শাহিনা আসেনি। বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য লাগে মতির। ছোট বেলায় তার মাকে একদিন করা যেন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো। মায়ের সেই মুখটা কেমন আলো ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির মত। মাঝে মাঝে মনে হয় মায়ের আবছা মুখের মত শাহিনার মুখটাও আবছা হয়ে যাবে। কিন্তু ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও শাহিনার মুখটা কেন ভুলতে পারে না? খাটের তলায় রাখা ধুলো জমা ট্রাঙ্কটা খুলে হাতড়ে কাপড় খোঁজে। অনেকদিন পর একধরনের নিঃশব্দ উচ্ছাস টের পায় নিজের মাঝে। আজকে শাহিনাকে দেখতে যাবে। সবচেয়ে ভালো শার্ট আর পান্ট পরে নেয় মতি। বহুদিন বাক্সবন্দী থাকার কারণে কাপড়ে কেমন একটা গুমোট গন্ধ। মতি হাত চালিয়ে শার্টটাকে নিপাট করার চেষ্টা করে। ভাঙ্গা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অগোছালো ময়লা চুলে হাত বুলিয়ে গোছানোর ব্যর্থ চেষ্টা। শাহিনার এক শিশি সুগন্ধি তেল ছিলো, সেটা পাওয়া গেলে চুলে মাখা যেতো। শাহিনার স্বামীর নাম ঠিকানা বলেছিল আলম। বেশি দূরে না, হেঁটে গেলে হয়ত তিন ঘন্টা লাগবে। অনেকদিন পরে একটা গন্তব্য পাওয়া গেছে।বারবার মতির মনে হয় এই পথের শেষে আনন্দময় কিছু আছে। দুপুর মাত্র পার হয়েছে, গ্রামের এই ছায়া মাখা রাস্তাটা নিরিবিলি থাকে এই সময়। মতি মাথা নিচু করে অকারণেই হাসে। আবার একটু গম্ভীর হয়ে যায়, শাহিনা যদি তাকে দেখে রেগে যায়? যদি ঠিক আগের মতই মুখ ফুলিয়ে বলে,' কিছু খান নাই, ঠিক না? মুখটা কেমন শুকায় গেছে ।' দূরে কথাও অজানা কোনো পাখি ডাকছে। কোকিল নাকি? মতি থমকে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবে। ঠিক পলাশরাঙা শাড়িটা পরে থাকবে নাকি শাহিনা ? অজানা কৌতহলে মতির ভেতরটা তোলপাড় করে। কুমারডাঙ্গা পৌঁছতে প্রায় শেষ বিকাল হয়ে গেল। গ্রামে ঢোকার মুখে কিছু জটলা দোকানপাট , ছোট খাটো হাটের মতো। মতি একটা দোকানে শাহিনার স্বামীর পরিচয় দিয়ে ঠিকানা নিয়ে নিলো। শাহিনার বাড়ির সামনে এসে মতি থমকে গেলো, কি সুন্দর বাড়ি! ঝকঝকে টিনের চালে সূর্যাস্তের শেষ আলো উজ্জল । পাকা বাড়ির সামনে থেকে ভেতরে ঢোকার লোহার গেট। সব ছবির মত সাজানো। মতি কি করবে বুঝতে পারে না। একবার ভাবে, ফিরে যাবে। তারপর আবার মনে হয় একবার শাহিনাকে দূর থেকে দেখে যাবে। মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। মাথায় টুপী পরে অল্প বয়সী একটা ছেলে বের হয়ে আসে। 'আপনে ক্যাডা ? কারে খুঁজেন? মতির গলা ধরে আসে। উত্কন্ঠা, উত্তেজনা আর কৌতহলে মতির মাথা এলোমেলো লাগছে। 'এই বাড়িতে কি শাহিনা নামে কেউ থাকে?' 'হ, থাকে। আপনে তার কাছে কি চান?' 'একটু দরকার ছিলো, অনেক দূর থেইকা আসছি।' ছেলেটা মতির পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে। মতি আরো আড়ষ্ট হয়ে যায়। কি ভেবে ছেলেটা গেটের ভেতরে ঢুকে যায়। মতির হাত পা কেমন যেন কাঁপছে। খুকখুক কাশি আসছে। এতক্ষণ তো কাশি ছিলো না, এখন কেনো এত কাশি আসছে কে জানে। মাথায় বড় ঘোমটা দিয়ে একজন বের হয়ে আসে। হলুদ রঙের শাড়ি সন্ধ্যার আলোতে ফুটে উঠেছে। মহিলা ঘোমটা একটু সরিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'আমার কাছে আসছেন? কি বিষয়?' মতি খুকখুক কাশতে থাকে। মহিলা ভালো করে ঘোমটা সরিয়ে মতিকে দেখে। মতিও বোকার মত হা করে শাহিনাকে দেখে। এ কয় বছরে আরো সুশ্রী হয়েছে। হাতে সোনার চুড়ি । এমন চুড়ি মতি কোনদিন কিনে দিতে পারেনি। মতিকে চিনতে শাহিনার কিছুটা সময় লাগলো। চিনতে পেরে চমকে দু পা পিছিয়ে গেলো। 'কেমন আছ শাহিনা?' 'এইখানে ক্যান আসছেন?' মতি লজ্জার মাথা খেয়ে বলে, 'তোমারে দেখতে আসছি, দেখতে মন চাইতেছিলো। ' 'এতদিন পরে মনে খায়েশ উঠছে? এতদিন উঠে নাই?' 'আগে আসলে আমার লগে যাইতা ?' 'না , যাইতাম না, আপনের মাথা নষ্ট হইয়া গ্যাছে। আপনের লগে কেউ থাকতে পারে না। ' কথাটা বলে শাহিনার ভয় লাগে। হঠাৎ মতি রেগে যায় যদি? বাড়ির লোকজন জানলে সর্বনাশ হবে। 'আপনে এইখান থেইকা যান। এক্ষনি চইলা যান, আর কোনদিন এইখানে আইবেন না। এইটা আমার স্বামীর বাড়ী। উনি জানতে পারলে আপনেরে খুন কইরা ফেলবে।' শাহিনা মুখে কাপড় চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। 'আইচ্ছা , তোমার কি কোনদিন আমার কথা মনে হয় নাই? মনে হয় নাই আমি বাইচা আছি না মইরা গেছি? একবার আমার খবর নিতে ইচ্ছা করে নাই?তোমরা সবাই আমারে ফালাইয়া চইলা গেলা?' অভিমানে মতির কথা জড়িয়ে যায় । ঠিক তখন গেটের ভেতর থেকে একটা ছোট ছেলে বেরিয়ে আসে, তিন চার বছর বয়স। ছেলেটা শাহিনার আঁচল ধরে অবাক হয়ে মতির দিকে তাকিয়ে থাকে, 'এইটা কে , মা?' মতি চমকে দেখে তার বাবলু সামনে দাঁড়িয়ে আছে! ঠিক একই রকম মায়া কাড়া চেহারা, গায়ের রং। মতি হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে ডাকে।শাহিনাকে অবাক করে দিয়ে অচেনা লোকটার দিকে তার ছেলে এগিয়ে যায়। মতি দুহাতে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত কাঁদতে থাকে। শাহিনার উত্তর দেয়ার আর প্রয়োজন নেই, মতি সব জবাব পেয়ে গেছে। ১ ফুলেশ্বর রায় এর দিন শুরু হয় ফজরের আযানের আগে। মসজিদের ইমাম আব্দুল করিমকে জ্বিনে খুব অত্যাচার করে। ফজরের আযান দিতে আব্দুল করিমকে বাড়ি থেকে খানিকটা পথ হেটে যেতে হয়। পথের দুই পাশে ভুট্টা ক্ষেত। মাঝখানে পায়ে হাটা সরু পথ। আযানের আগে বাড়ি থেকে মসজিদে যেতে প্রায় প্রতিদিন ভুট্টা ক্ষেত থেকে জ্বিনে ডাকে করিমকে। পিছন থেকে বলে -হুজুর কই যান? হুজুর পিছনে ফিরে তাকায় না। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ যখন একা থাকে তখন সাহসের একটা সীমা থাকে। তারপর আর পারেনা। দিনের বেলা করিম ফুলেশের সাথে তার মনের কথা বলে। ফুলেশ্বর খুব সাহসী মানুষ। ঘটনা শুনে করিমকে বলে -হুজুর, বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমার মোবাইলে একটা মিসকল দিবেন। আমি আপনাকে বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত পৌছায়ে দিয়া আসবো। করিম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে একটু শক্তি যোগায়। এরপর থেকে করিম প্রতিদিন ফজরের আযানের আগে ফুলেশ্বরের মিসকলের অপেক্ষায় থাকে। এই ফুলেশ্বর অভিমান করে পৃথিবী থেকে চলে গেছে। আব্দুল করিম কৃষি খামারের মসজিদের ইমাম। পরিবার নিয়ে থাকে খামারের ভিতরে উত্তর কোনে একটা আধপাকা ঘরে। ফুলেশ্বরের বাড়ি খামারের উত্তরে। করিমকে অবসরে খামারে টুকটাক কাজ করতে হয়। কিন্তু কাজে করিমের একটু অনীহা। ইমাম সাহেব কাজ করলে তার গায়ের সাদা জামা কাপড় দ্রুত ময়লা হয়ে যায়। ফুলেশ্বর ক্ষুদ্র কৃষক। নিজের যা জমি আছে তাতে চাষবাস করে দিন চলে যায়। বউ আর দুই ছেলের সংসারে কতোই আর দরকার। নিজের ক্ষেতে দিনের কিছু সময় কাজ করলে সারাদিন অলস পড়ে থাকে। অন্যের কাজ করবে সেটা তার দ্বারা সম্ভব না। আত্মমর্যাদা বোধ অনেক। মজুরীর বিনিময়ে কাজ করে না সে। তবে অবসরের পুরো সময়টা মেজর সাহেবের খামারে পড়ে থাকে। তার বিনিময়ে সে কিছু আশা করে না তা নয়। মেজর সাহেব তার জন্য অনেক করে। তার পরও এতো বড় একটা খামারকে সে নিজের মনে করেই সব করে। করিমেরও অনেকটা স্বস্তির কারণ ফুলেশ। নিজ দায়িত্বে পুকুরে নেমে আবর্জনা পরিষ্কার করছে। ফুলেশ জানে কোন পাশের জঙ্গলায় বিষাক্ত সাপের উৎপাত। সেদিকে জঙ্গলা একটু বড় হতে দেখলেই দা হাতে লেগে যাবে পরিষ্কার করতে। ম্যানেজার আছে খামারে একজন। তাকে দিয়ে কোন কাজ হয় না। রাতভর মুভি দেখে আর সারা দিন ঘুমায়। জবাব যা দেয়ার তা ফুলেশ আর করিমকেই দিতে হয়। আর করিমের ভরসা ফুলেশ। খামার থেকে মাইল খানেক মাটির রাস্তায় হেটে যেতে হয় ঢোলারহাট বাজারে। মাগরিবের নামাজের পর করিম বাজারে যায় সংসারের কেনাকাটা করতে। সঙ্গী ফুলেশ। এই রাস্তাটাকে বলে পুরাতন দার্জিলিং রোড। অনেক অনেক বছর আগে এই অঞ্চলের মানুষকে এই পথেই দার্জিলিং যেতে হতো তাই নামটা এখনো রয়ে গেছে। এখন অবশ্য অনেক বড় পাকা রাস্তা হয়েছে। এই পুরাতন দার্জিলিং রোডে এখন কিছু বাইসাইকেল চলে আর পায়ে হেটে কিছু মানুষ চলাচল করে। রাস্তার দুই পাশে আলু ক্ষেত। পাকা বাড়ি ঘর নেই। দূরে কিছু ছনের চাল দেখা যায়। যেদিন গ্যাংটকএ ভূমিকম্প হলো সেদিন করিম আর ফুলেশ বাজার করে এই পথে বাড়ি ফিরছিলো। মাঝ পথে এসেই মাটি কাঁপতে শুরু করলো। মনে হচ্ছিলো পায়ের নীচের মাটি উল্টে পাল্টে যাবে। দাড়িয়ে থাকা যাচ্ছিলো না। দুজনেই মাটিতে আছড়ে পড়ে। দুজনেই বাজারের ব্যাগ হাত থেকে ফেলে দেয়। করিম আর ফুলেশ একজন আরেকজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে। করিম চিৎকার করে বলে যাচ্ছে -লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ... আর ফুলেশ রাম... রাম... করে চিৎকার করছে। দুজনের বুকে একই হৃদকম্পনের শব্দ। একজন অন্য জনের হৃদকম্পন শুনতে পাচ্ছে। ২ মেজর সাহেব দুই তিন মাস পর পর তিন চার দিনের জন্য খামারে বেড়াতে আসেন। তখন ফুলেশ্বরের নাওয়া খাওয়া বন্ধ। বাগানের আগাছা পরিষ্কার করা। পুকুর পাড়ের আগাছা পরিষ্কার করা। লিচু বাগানের আগাছা পরিষ্কার করা কুমড়া ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করা। মেজর সাহেব আসলে দোতলা বাংলো বাড়ির তালা খোলা হয়। দুই তিন মাসের জমে থাকা ধুলা ময়লা পরিষ্কার করে বিছানা পত্র গুছিয়ে বাড়ি চলে যায় ফুলেশ। ছোট কাল থেকে মেজর সাহেবকে মামা বলে ডাকে ফুলেশ। মামা একটু বিশ্রাম নিলে সন্ধ্যার পর চা খেতে খেতে গল্প জমে ফুলেশের সাথে। মেজর সাহেব ফুলেশের মনে যত্ন করে পুষে রাখা স্বপ্নের কথা জানে। মানুষের নিজের জন্য স্বপ্ন দেখার সময় ফুরিয়ে গেলে শুরু হয় সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য স্বপ্ন দেখা। প্রত্যেক মানুষ তার নিজের মতো করে স্বপ্ন দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাবা মায়ের চাপিয়ে দেয়া স্বপ্ন সন্তানের মন খুব একটা স্পর্শ করেনা। সন্তান তখন তার স্বপ্ন নিজের মতো করে সাজায়। সন্তানের মনের কথা বুঝার সক্ষমতা সব বাবা মায়ের থাকে না। দরিদ্র ফুলেশ্বর রায়ের স্বপ্ন তার ছেলে লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। মামার মতো মেজর সাহেব হবে। তাকে পড়াশোনায় অনেক ভালো করতে হবে। ছেলের ভালো পড়াশোনার জন্য অনেক টাকা দরকার এই খামারে নিজ দায়িত্বে বাড়তি কাজ করে যা কিছু পায় তার পুরোটাই কাজে লাগে ছেলের স্কুল মাস্টার কোচিং এই সব খাতে। দোতলায় জানালার পাশে সোফায় বসে আছে মেজর সাহেব। পাশে সিগারেটের প্যাকেট। একটার পর একটা জ্বলছে সিগারেট। একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে মেঝেতে লাল মাদুরে বসে আছে ফুলেশ। এই গ্রামের সব খবর রাখে ফুলেশ। কে কার বিরুদ্ধে মামলা করলো। মামলা সত্যি কি মিথ্যা। কার বউ দুই বাচ্চা রেখে কার সাথে পালিয়ে গেলো। মেজর সাহেব সব কথা খুব মন দিয়ে শোনে। গল্প শুনে শুনে তার দরকারী তথ্য গুলো জেনে নেয়। শোনার ফাঁকে আবিষ্কার করে আশপাশে কার জমি বিক্রির সময় হলো। মানুষ বিপদে পড়লে জমি ভিটে বাড়ি বিক্রি করতে হয়। তাই ফুলেশের সব গল্প খুব মন দিয়ে শুনতে হয় মেজর সাহেবকে। সব কথা শেষে আসে ফুলেশের পরিবারের কথায়। মেজর সাহেব ফুলেশের পরিবারের জন্য অনেক করে। নিজ থেকে না চাইলেও করে। মেজর সাহেব জানতে চায় -তোর বউ বাচ্চা কেমন আছে? -ভালো আছে মামা। বড়টাকে কোচিংএ ভর্তি করাইছি। কিন্তু মামা তার লেখাপড়ায় আমার অসন্তুষ্ট লাগে। -ঘরে ধান চাল আছে? বছর চলবে? -তা যাবে। কিন্তু ছেলের পড়ার সব খরচের টাকার যোগান দিতে অর্ধেক ধান বিক্র করে দিতে হবে। আপনে তো চল্লিশ হাজার টাকা পাবেন... কখন যে দিতে পারি... -সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। এই নে এখানে দশ হাজার টাকা আছে। বলে মানিব্যাগ থেকে দশটা হাজার টাকার নোট বের করে দেয় মেজর সাহেব। ফুলেশ বরাবরের মতো কাঁচুমাচু করে হাতটা বাড়িয়ে মুখে বলে -তা লাগবে না মামা। আপনি আর কতো দিবেন... -লাগবেনা জানি। হাতে রেখে দে কাজে লাগবে। আর শোন উত্তরের লিচু বাগানে কুমড়োর যা ফলন আসে বিক্রি করে করিমকে হাজার দুই টাকা দিয়ে বাকীটা তুই নিয়ে নিস। আর লিচু বিক্রির ত্রিশ ভাগ তোর বিশ ভাগ করিমের আর বাকীটা মসজিদের হিসাবে দিয়ে দিস। -চা দিবো মামা? -দে একটু লাল চা করে দে। -মামা কি পূর্ব পাশের জানালা খোলা রেখে ঘুমান? -হ্যা। যা গরম! রাতে বিদ্যুত কখন যায় কখন আসে... -বলছিলাম কি জানালা ঘেষে তো বকুল গাছের ঢাল পাতা। রাতে সাপের উৎপাত বেড়েছে খুব। সেদিন নিচ তলায় ম্যানেজার সাহেবের ঘরের দরোজায় একটা গোখরো সাপ বসেছিলো। রাত তিনটার সময় আমাকে ফোন করে। ঘুম থেকে উঠে লাঠি নিয়ে দৌড়ে এসে সেই সাপ মেরে ফেলতে হয়েছে। মারার ইচ্ছা ছিলো না তাড়িয়ে দিতে চেয়েছি কিন্তু বার বার তেড়ে আসছিলো । এখন মামা এর জোড়াটা আশেপাশে ঘুরাফেরা করে। -বলিস কি! একটু ভয় পেয় টর্চ হাতে দাড়িয়ে যায় মেজর সাহেব। ফুলেশকে বলে -তোর সাথে টর্চ আছে? -জি আছে মামা। -আয়তো একটু দেখি। দোতলার খাটের নিচ থেকে শুরু করে বাথরুম রান্নাঘর বাড়ান্দা এমনকি আলমারীর নিচে ভালো করে দেখে নেয়। ফুলেশ বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে দরজার ফাঁক ফোঁকর বন্ধ করে যায়। ৩ প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির গড়মিল অনেক পুরোনো। মানুষ তার নিজের জীবনের অতৃপ্ত ভাসনা পূরণ করতে বীজ বপন করে সন্তানের জীবনে। সন্তানের নিজস্ব একটা জগৎ নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা আছে এটা মেনে নিতে পারেনা অনেকেই। কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত মা বাবা। সাঁওতাল পল্লীর ফুলেশ্বর রায় এর নিজস্ব জাতিস্বত্তা বলতে বিশেষ কিছু এখন আর নেই। ওরা এখন মিশ্র এক সংস্কৃতির বাসিন্দা। এক সময় মাঠের পর মাঠ অনাবাদী জমি ছিলো। এখন সব জমিতেই ফসল ফলে। চাষের জন্য পানির অভাব ছিলো বিদেশী অনুদানে কয়েক পরিবারের জন্য একেকটি গভীর নলকূপ স্থাপন হয়েছে। ফসলে মাঠের পর মাঠ সবুজ থাকে এখন সারা বছর। কিন্তু বেশীর ভাগ জমির মালিকানা হাত বদল হয়ে গেছে। দক্ষিণ অঞ্চলের চালাক মানুষ গুলো দুশ পাঁচশ টাকা বিঘা হিসাবে শত শত বিঘা জমির মালিক হয়েছে। যমুনা সেতু হবার পর বছর বছর বাড়তে থাকে জমির দাম। ততোদিনে ফুলেশ্বর রায়রা প্রায় ভূমিহীন। ফুলেশের এখনো তবু কিছু আছে। ছোট সংসারে বছরের খাবার জুটে। নতুন বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ছোঁয়া লেগেছে সবার মাঝে। ছেলে মেয়েরা স্কুল কলেজে যায়। পড়াশোনা শেষে দেশে বিদেশে ছোট বড় চাকুরী করে। ফুলেশ্বরের স্বপ্ন তার বড় ছেলে উজ্জ্বল রায় ভালো পড়াশোনা করবে। সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে চাকুরী পাবে। তাই ছেলেদের পড়াশোনার খরচের টাকার বাড়তি যোগান দিতে এদিক সেদিক ছুটতে হয় ফুলেশকে। করিম হুজুর জানে ফুলেশ পরের কাজ করে না কিন্তু এক দুই মাস পর পর তাকে গ্রামে দেখা যায় না। দুই তিন সপ্তাহ পর আবার ফিরে আসে। ফুলেশের এই হারিয়ে যাওয়ার ব্যপারটা নিয়ে একদিন কথা তুলে করিম -দাদা একটা কথা বলবে? -কি কথা বলেন? -তুমি কোথায় যাও মাঝে মাঝে? ফুলেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে -একেতো আমি মিথ্যা বলতে পারি না তার পর আপনে হুজুর মানুষ... কি করে যে বলি... শোনেন তাহলে। ইন্ডিয়াতে আমার এক ভাই থাকে তাতো জানেন। -তা জানি। -বর্ডার পার হয়ে তার কাছে চলে যাই। তার সাথে কিছু কাম কাজ করি। কামটা অনেক কঠিন। অনেক ঝামেলার। যে কোন সময় জীবনটাও যেতে পারে। কি করবো? সংসার তো চলতে হবে। ছেলেপেলে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। -কি কাম করেন? বলবে কি বলবে না কিছুক্ষণ ভেবে মুখ খুলে ফুলেশ। করিম হুজুর তার খুব প্রিয় মানুষ। কাছের বন্ধু। এমন ভালো বন্ধু সহজে মিলে না। ফুলেশ বলে -সেখানে দুই ভাই মিলে দুইটা বাইসাইকেল নিয়ে নেপাল বর্ডারে চলে যাই। সাইকেলের দুই পাশে চারটে প্লাস্টিক কন্টেইনার ভরে ডিজেল নিয়ে নেপাল ঢুকে যাই। সেখানে বেশী দামে বেঁচে ফিরার পথে বস্তায় চিনি নিয়ে আবার ইন্ডিয়াতে ফিরে আসি। এই করে কিছু টাকা পাই। কি করবো বলেন? পোলাপানের লেখাপড়ায় অনেক নগদ টাকা লাগে। হুজুর আপনে এই কথা আর কাউকে বলবেন না জানি। তবুও বলছি কথাটা আপনার মধ্যেই রাইখেন। -সে আমি আর কাউকে বলবো না দাদা। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। ৪ ফুলেশ আজ বউকে পিটিয়েছে। দুঃখ কষ্ট আঘাত সব ছোয়াছে রোগের মতো। দিন সাতেক আগে ফুলেশের ফসলের ক্ষেত ক্ষতি করে প্রতিবেশী হারুনের গরু। এই নিয়ে হারুনের সাথে তর্ক ঝগড়া এক পর্যায়ে হাতাহাতি হয়। হারুন ফুলেশের হাড্ডিসার শরির দেখে মনে করেছিলো দুচারটা কিল ঘুষিতেই ব্যাটা ঘায়েল হয়ে যাবে। হাড্ডি আর চামরার নীচে এতো অসুরের শক্তি কে জানতো! হারুন উল্টো হেরে যায়। হারুন গ্রাম্য মাতবরদের কাছে মার খাওয়া আর অপমানের নালিশ দেয়। সালিশ বসে। সমাজপতিরা খুব চতুর। দুই পক্ষ সবল থাকলে তারা মাসের পর মাস বছরের পর বছর সমাধান ঝুলিয়ে রাখে। কেউ আবার দুই পক্ষের হাত এক করে মিলে মিশে বসবাস করার পরামর্শ দেয়। চোখের জল ফেলে দুজনে বুকে বুক মিলিয়ে নেয়। এক পক্ষ দুর্বল হলে তাদের বিচারের সমাধান দিতে সহজ হয়। ফুলেশ্বর তুলনামূলক ভাবে দুর্বল প্রতিপক্ষ। দুর্বলের বিপক্ষে রায় দেয়া সহজ। ফুলেশ অপরাধী সাভ্যস্থ হয়। বিচারে উপস্থিত সভায় দশটা জুতার বাড়ি খাবে ফুলেশ। এমন হাতাহাতি তর্কাতর্কির মতো ঘটনা গ্রামে কতোই ঘটে তার জন্য শতশত মানুষের সামনে জুতার বাড়ি খাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। শালিসে ফুলেশ্বরের স্ত্রী পুত্রের নিরব উপস্থিতি ছিলো। স্ত্রী পুত্রের সামনে নিজের প্রতি অবিচারে বেঁচে থেকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করলো ফুলেশ্বর রায়। এই ঘটনায় ফুলেশের গোছানো সংসারটার ভীত নড়ে যায়। ফুলেশ তার বড় ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছে। একে নিয়ে আর আশা নেই। লেখাপড়ায় তেমন ভালো করতে পারেনি তবুও তো চালিয়ে যাচ্ছিলো। সালিশে স্ত্রী পুত্রের সামনে অপমানে ফুলেশ আধ পাগলের মতো আচরণ করছে আজকাল। পড়ালেখা করে উজ্জল রায়ের কিছু বন্ধু স্বজন জুটেছে। তাদের কানেও গেছে খবরটা। মনের দুঃখে জীবনে প্রথমবার গাঁজার কল্কীতে হাত দেয় উজ্জল রায়। প্রথম দিন তারপর প্রতিদিন চলতে থাকে। এক কান দুইকান করে বাবা ফুলেশ্বরের কানেও আসে। ফুলেশ্বরের ধারণা মিথ্যে না। মা গোপনে ধান বিক্র করে ছেলের বাড়তি হাত খরচের টাকার যোগান দেয়। তা সে অনেক দিন ধরেই দিয়ে আসছে। জানা গেলো গাঁজা ধরার পর। মায়েরা ছেলের অপকর্মের কথা বিশ্বাস করতে চায় না। বাবার চাক্ষুষ প্রমাণ থাকলেও না। মায়ের কাছে তার সন্তান পৃথিবীর শ্রেষ্ট সন্তান। এই নিয়ে বিকেলে স্বামী স্ত্রীতে তর্ক লাগে। বউ মানতেই চাইছেনা তার ছেলে নেশা করে। এও মানছে না গোপনে হাত খরচের টাকা দিয়ে সে ভুল করেছে। স্বামীর সাথে উল্টো তর্ক করছে। ভুল আর শুদ্ধ যাই হোক মায়ের ভালোবাসা এমনই অন্ধ হয়। সন্ধ্যা গড়িয়ে কালো হয়ে এসেছে চার পাশ। উত্তেজিত ফুলেশ বউএর চুলের মুঠি ধরে টানতে থাকে -আয় আমার সাথে, দেখে যা। তোর পুত্রধন স্কুল ঘরের পিছনে কাদের নিয়ে কি করছে... রাতে খাবার রান্না হয়নি। বউ বালিশে মুখ গুঁজে বিছানায় শুয়ে আছে। ক্ষুধার্ত ফুলেশ বাড়ান্দায় বসে বকবক করে যাচ্ছে। রাত দশটায় ছেলে বাড়ি ফিরলে তাকে দেখে মাথায় আগুন ধরে ফুলেশের। ছেলের বাড়ি ফিরার শব্দ শুনে মা আর আবেগ ধরে রাখতে পারছে না। এতোক্ষণের জমে থাকা আবেগ বাধ ভেঙে বের হতে চাইছে। ছেলে মায়ের কাছে খাবার চাইলে মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ফুলেশ তখনো বাড়ান্দায় খুটিতে হেলান দিয়ে মাথায় হাত রেখে বসে আছে। ঘরের ভিতর থেকে জোরে কান্নার শব্দ কানে আসতেই দাড়িয়ে দরজার দিকে তাকায় ফুলেশ। চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে -এখন থামবি? না থামলে কিন্তু একেবারে মেরেই ফেলবো। ঘর থেকে ছেলে উজ্জল উত্তেজিত হয়ে বের হয়। বাবার সামনে এসে দাড়িয়ে বলে -তোর ক্ষমতা থাকলে মাকে মারতে আয়! ফুলেশ্বর হা করে কিছুক্ষণ ছেলের মুখের দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকে। ছেলের এই মারমুখো রুপ দেখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবশ হয়ে আসে ফুলেশ্বরের। ফুলেশ্বর মাথা নিচু করে বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। ৫ করিম হুজুর ফজরের আযান দিয়ে প্রতিদিনের মতো মুসুল্লিদের জন্য অপেক্ষা করে। মুসুল্লি আসে না। আশেপাশে দু চার ঘর মুসলিম পরিবার বাদ দিলে বাকী সব হিন্দু পরিবার। মুসলিম পরিবারের কর্তারা খুব ভোরে নদীতে মাছ ধরতে চলে যায়। ফজরের নামাজটা প্রতিদিন ইমাম সাহেবকে একাই আদায় করতে হয়। তাই সে নামাজ একটু আগেই সেরে ফেলে। এতো দিনে বেশ কিছু ভালো নামাজী জ্বিনদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠেছে। তার ধারণা ফজরের নামাজ সে একা আদায় করে না। তার পিছনে কিছু জ্বিন নামাজ আদায় করে। জ্বিনকে এখন আর সে ভয় পায় না। সূর্য উঠতে থাকে আর মক্তবে আরবি পড়ার জন্য বাচ্চারা আসতে থাকে একে একে। এই সময়টুকু পুকুর পাড়ে হেটে নেয়। করিম হাঁটতে হাঁটতে পূর্বপাশে আট নাম্বার পুকুরের পাড়ে চলে যায়। কাঁঠাল গাছের দিকে চোখ পড়তেই অজ্ঞান হয়ে পরে যাওয়ার অবস্থা। কাঁঠাল গাছের ঢালে একটা লাশ ঝুলে আছে। গলায় দড়ি। দেখতে ঠিক ফুলেশের মতো! হ্যা ফুলেশ্বর রায়! গ্রামের সব মানুষ এর মধ্যে কাঁঠাল গাছটি ঘিরে দাড়িয়ে আছে। মাটি থেকে দেড় ফুট উপরে ঝুলে আছে ফুলেশের পা দুটি। ছেলে উজ্জ্বল রায় হাঁটু গেড়ে বসে বাবার লাশের পা দুটি শক্ত করে চেপে ধরে আছে বুকের মধ্যে। ছেলের কান্নার কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না। ক্ষণিকের কান্নার শব্দ বাতাসে ভাসে। আজীবনের কান্নার শব্দ বাতাস নাগাল পায় না। সেই কান্না বাসা বাঁধে মানুষের বুকের মধ্যে। আজীবনের প্রায়শ্চিত্তে বুকের সেই জমাট বাঁধা কান্নার বরফ গলে না। ====== পাদটীকাঃ গল্পটি সত্যি ঘটনার অবলম্বনে লেখা। যাকে নিয়ে এই গল্প সেই ফুলেশ্বর রায় (ফুলেশ) আমার দেখা কিছু সংখ্যক ভালো মানুষের একজন ছিলেন। ১. আমি সামসুন্নাহার যুথী। কিন্তু ইদানিং আমাকে স্বপ্ন নামে ডাকলে আমার খুব ভাল লাগে। এই নামটা দিয়েছে আমার সূর্য। আমি আজ আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদকে নিজের হাতে বিসর্জন দিয়েছি। এখন টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছি। সাথে যে ছেলেটি, আমি যার হাতটি পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে হাঁটছি, আমার চাচাতো ভাই মনির। মনির কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি আমি কোনদিন বেঁচে থাকতে ওর এতো ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটব। আমি দেখতে খারাপ, একথা আমার শত্রুও বলবেনা। ৫ফিট ৬ইঞ্চি লম্বা ফর্সা চেহারার একটি মেয়ে। রাস্তায় হেটে গেলে অনেকেই হা করে তাকিয়ে থাকে। এটা দেখতে দেখতে আমার এখন আর অবাক লাগেনা। আজকে এই ১লা বৈশাখের মেলায় মনিরের সাথে এভাবে আসব, একথা পৃথিবীর কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। মনিরও জানেনা একটু পরে কি ঘটতে যাচ্ছে। আমার একটা মেয়ে আছে, আমার সূর্য আছে, তারপরও। ঐ তো সূর্য আমার মেয়েটাকে কাঁধে তুলে রাজু ভাস্কর্যের উল্টোদিকে পাথরের মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছে। এটা দেখে আমি মোটেও অবাক হচ্ছিনা বরং আমি যে ওদেরকে দেখছি এটা ওদের বুঝতে দিচ্ছিনা। ২. হাজিগঞ্জ (চাঁদপুর) জেলায় শাহরাস্তী উপজেলার নিজমেহার গ্রামে আমাদের বাড়ীটা বিশাল, যৌথ পরিবার যাকে বলে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জেঠা, কাকা তাদের ছেলে মেয়ে সবাই একই বাড়ীতে। আপাতত আমিই এই পরিবারের শেষ প্রজন্ম। আমার একভাই, নাম গোলাম আহসান বিপ্লব চাকুরী করেন, এখনও বিয়ে করেননি। প্রায়ই তার বাড়ীর বাইরে থাকা হয়। বর্তমানে ভাইয়া নারায়ণগঞ্জের সিদ্দিরগঞ্জ উপজেলার চিটাগাংরোডে এককামড়ার একটা ভাড়া বাসায় থাকেন। আর দশটা মেয়ের মতো মাথার দুপাশে বেনি দুলিয়ে স্কুল ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যাই। চাচাতো জেঠাতো ভাইবোনরা সাথী হয়। মেঝ চাচার ছোট ছেলে শান্ত এবং আমি ক্লাস এইটে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। শিউলী, জোৎস্না, মনির, বনি, দশম শ্রেণীতে পড়ে, পরীক্ষার্থী। এরা সবাই আমার চাচাতো-জেঠাতো ভাই-বোন। কদিন স্কুল বন্ধ। ভিসিআরে বাংলা, হিন্দি ছবি দেখে আর ওদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটে। সুখের সংসারে আগুন লাগা যেন একটা নিয়মিত ব্যপার। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরেন। আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ায় ভাইয়া বাড়ী এসেছেন। বাবাকে নিয়ে কালীবাড়ীতে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার দেখে শুনে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসার কথা বললেন। বাবার অবস্থা আরেকটু খারাপ হলে ভাইয়া বাবা ও মাকে নিয়ে ঢাকা চলে গেলেন। আমাকে আমার জেঠাতো বোন শিউলীকে সাথে এনে থাকার ব্যবস্থা করে গেলেন। প্রথমদিন ভয় করলেও পরের দিন মুক্ত জীবনের স্বাদ পেয়ে আর খারাপ লাগলোনা। পরদিন মেঝো চাচার বড় ছেলে বনি ও বড়চাচার ছোট ছেলে মনির ওদের ভিসিআর এবং কয়েকটা হিন্দি ছবি নিয়ে আমাদের ঘরে এলো। বড় চাচা দুবাই থাকেন। তার ঘরে ভিসিআর, ভিডিও ক্যামেরা, ইলেকট্রিক ওভেন সবই ছিল। আমি ও শিউলী আপা টিভিতে নাটক দেখছিলাম। ভিসিআর আনাতে আমরা দুজনই পুলকিত হলাম। শীতের রাত। আমরা সবাই কাথা মুড়িদিয়ে "খুলি খিড়কি" নামে একটা হিন্দি ছবি দেখছিলাম। তার আগে আরো দুটা ছবি দেখা শেষ হয়েছে। আমার ডান পাশে তাকিয়ে দেখলাম শিউলী আপু ঘুমিয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ পরে আমি আমার বুকে একটা হাতের স্পর্শ পাই। আমার পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। আমি যেন নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমার শরীর জমে কংক্রিটের মতো হয়ে গেছে। মনিরের হাতটা আমি সরিয়ে দিতে পারছিলামনা। কি যেন অজানা একটা অনুভূতি আমায় গ্রাস করে নিচ্ছিলো। মনিরের হাত আমার সুঢৌল দুটি স্তন যেন মিশিয়ে দিতে চাইছিল আমার দেহের সাথে। এই শীতের রাতেও আমি ঘেমে যাচ্ছিলাম। অনেক কষ্টে মনিরের দিকে ফিরে দেখলাম ওর পাশে বনিও ঘুমিয়ে গেছে। টিভির পর্দায় যুবতি একটা মেয়ে তার ঘরের বাথরুমে গোসল করছে, দেহের অনেকটাই দেখা যায়। জানলা দিয়ে সমবয়সী একটা ছেলে আড়ালে তাকিয়ে দেখছে মেয়েটার গোসল করা। মনিরের হাত আমার বুক থেকে পেট ছুঁয়ে নিচে নেমে যায়। আমার দেহে একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। মনে হলো আমার স্যালোয়ার ভিজে যাচ্ছে। আস্তে করে উঠে গেলাম। আমাদের দু'কামড়ার ঘরের লাগোয়া একটা বড় বাথরুম। নেমেই আমি সোজা বাথরুমে চলে এলাম। নিঃশব্দে মনির যে কখন আমার পিছনে পিছনে বাথরুমে চলে এসেছে খেয়ালই করিনি। আমার মুখটা চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে - কিছু হবেনা, চুপ করে থাক। আমার মুখে কোন রা নেই। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। মনির সুনিপুন হাতে আমার স্যালোয়ার খুলে ফেলে। আমি দুটো পা পেচিয়ে আমার লজ্জা ঢাকার বৃথা চেষ্টা করি। আস্তে আস্তে আমার কামিজটাও খুলে ফেললো। আমার শরীরে কাপড় বলতে শুধু ব্রা- টা অবশিষ্ট আছে। মনিরের চেষ্টায় সেটাও আর থাকলোনা। শীতের রাতে টিভির হালকা আলোতে স্পস্ট কিছুই দেখা যাচ্ছিলনা। মনির আমাকে ধরে বাথরুমের ফ্লোরে শুইয়ে দিল। অসীম উৎসাহে প্রাগৈতিহাসিক জৈবিক চাহিদা মিটে যায় দুজনের। - এই ট্যাবলেট দুটো রাখ। ঘুমানোর আগে খেয়ে ফেলিস। : কিসের ঔষধ? - এতো জানা লাগবেনা। আমি গোসল সেরে এসে শিউলী আপুর সাথে শুয়ে পরি। বুকে হাত দিতেই একটা ব্যথা অনুভব করলাম। কখন যে মনিরের ধারালো দাঁতের কামড়ে আমার স্তনের বোটা খানিকটা কেটে গেছে খেয়ালই করিনি। মনির বনিকে ডেকে তুলে ওদের ঘরে চলে যায়। পরদিন রাতে আমার আর ভালো লাগছিলনা, কেমন একটা চাওয়া ভেতরে ভেতরে অনুভব করতে লাগলাম। বাবার অসুখটা সেরেছে। কিন্তু খুব ভালো খবর নেই। প্রায়ই তাকে নিয়ে ঢাকা যেতে হবে চেকআপের জন্য। ১৫দিন পর মা বাবাকে নিয়ে ফিরে এলেন। এই ১৫দিনে আমার ভেতর অনেক পরিবর্তন এসেছে। সবার সামনে যেতে লজ্জা লাগে। বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারিনা। এভাবে ৬টি মাস চলে যায়। আমি নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছি। মনির ভর্তি হয়েছে কুমিল্লা পলিটেকনিকে। আমাদের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ৩. আজ আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান। কেমন যেন একটা অনুভুতি, নতুনকে পাবার আকাঙ্খা, আবার এতোদিনের একটা পরিবেশ, বন্ধু ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট। আমাকে মাইকে কিছু বলতে বলা হলো। কি বলব, কথা বলতে গিয়ে নাকের পানি চোখের পানি সব একাকার। অনুষ্ঠান শেষে দেখলাম বনি ভাইয়া এগিয়ে আসছে, হাতে ক্যামেরা। সামিয়ানার নিচে বসে আমরা অনেক গল্প করলাম। বনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনা করছে। ওর কলেজের কথা, বন্ধুদের কথা অনেক কথা বললো। আমার কিছু ছবিও তুললো। ওর শেষ কথাটা এখনও আমার কানে বাজছে "যুথী আমি তোকে ভালবাসি"। কথাটা বলেই ও দ্রুত চলে যায়। এ দুবছরে আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমি ভালোবাসা বুঝতে শিখেছি, যৌনতা কি জিনিস তাও জেনেছি। আমার মনে পরে গেল মনিরের কথা। কই মনিরতো কখনও আমাকে ভালবাসি বলেনি? বনির কথায় আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন হতে লাগলো। নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হতে লাগলো। বনির সাথে আমার কথা হয়, ও চিঠি লিখে, আমিও লিখি। এভাবেই চলতে থাকে আমাদের ভালোবাসা। আমার পরীক্ষা শেষ হয়। এদিকে বাবার অবস্থা আরো খারাপ হয়। ভাইয়ারও চাকুরীর সমস্যা হতে থাকে। একদিন ভাইয়া মাকে বলল- = মা চলো সবাই ঢাকা চলে যাই। যুথীরও পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ওকে ঢাকায় ভালো একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবো। বাবাকেও কষ্ট করে দৌড়াদৌড়ি করতে হবেনা। আর আমারও চাকুরীটার সমস্যা হবেনা। :: বাবা তোর আয়েই তো সংসার চলছে। জমি জিরাত থেকে যা পাই তাতেতো চলবেনা, তাই তোর চাকুরীটার সমস্যা হলে ভীষন অসুবিধা হয়ে যাবে। = তাহলে বাবাকে বুঝিয়ে বলো। :: ঠিক আছে বাবা। মা আর ভাইয়ার কথা শুনি। আমার ভেতরটা হু হু করে ওঠে। আমরা চলে গেলে বনির সাথে দেখা হবেনা। আমার কিশোরী মনে তখন অন্য কিছু নেই। ভাবতেও পারিনা, আমার সমস্ত চিন্তা জুড়ে শুধু বনি। সামনে বিশাল শুন্যতা, যেখানে নিজের খুশিতে সাজিয়ে নেওয়া যায় নিজের পৃথিবী। গ্রীষ্মের ছুটিতে বনি বাড়ী আসে। আমি তাকে সব খুলে বলি। বনি শুধু অসীম আদরে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, - তুই কি আমাকে ভালোবাসিস না? : আমি বনির বুকে মুখ ঘষে সম্মতি দিয়ে জানাই হ্যা ভালবাসি। - তাহলে চিন্তা করছিস কেন? : তোমাকে দেখতে পাবোনা। তোমার ছোয়া পাবোনা। আমার দিনগুলো কিভাবে কাটবে? - দুর বোকা, আমিতো হারিয়ে যাচ্ছি না। বনি আমার কপালে আলতো ভাবে একটা চুমো একে দেয়। আমি হারিয়ে যাই অজানা একটা দ্বীপে, যেখানে আমি আছি, বনি আছে, আছে চির সবুজে ঘেরা গাছপালা যেখানে পাখিরা বাসা বেধেছে নিশ্চিন্ত মনে। সেখানে হারাবার কোন ভয় নেই। নেই কোন কলুষতা। দুজনে মিলে ঠিক করি, বনি ফ্রান্স চলে যাবে। আমি ইন্টার পাশ করার পর ফিরে এসে বিয়ে করবে। সুন্দর একটা রঙিন স্বপ্ন নিয়ে মা-বাবা ও ভাইয়ার সাথে আমরা ঢাকা চলে আসি। ডেমরা থানার সারুলিয়া ইউনিয়নের হাজীনগরে একটা ফ্লাট ভাড়া নেয়া হয়েছে। ভাইয়া আমাকে সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে ভর্তি করে দেয়। দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে যায়। আমার পরীক্ষা শেষ হয়। ৪. এই দুই বছরে আমার চিন্তা চেতনা অনেক সম্বৃদ্ধ হয়েছে। মফস্বল শহরের ছোট্ট একটা গ্রামে কেটেছে আমার ষোলটি বছর। সেখানে প্রতিদিন একই মুখ দেখেছি প্রতিনিয়ত। শহরের যান্ত্রিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে এখানে মানুষগুলো বদলে যায় চোখের পলকেই। ভালোবাসা মানুষকে ধরে রাখতে পারেনা। পরিবর্তনকে আটকে দেয়ার শক্তি ভালোবাসার নেই। পরীক্ষা শেষে ঘরে বসে রইলাম কিছু দিন। কেমন একঘেয়ে লাগছে। = কিরে তুই এমন মনমরা হয়ে বসে থাকিস কেন? ভাইয়া মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে বলে। :: আমিও দেখছি কদিন ধরে মেয়েটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। মা বলেন : আমি শুকনো হাসি দিয়ে বলি, কই কিছু হয়নি তো। = কিছু হয়নি বললেই হলো? : না ভাইয়া কিছুই হয়নি। পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেছে। কেমন যেন বেকার বেকার লাগছে। =ও এই কথা । তা তুই কোথাও কম্পিউটার শিখতে যা। এখন যে যুগ পরেছে, সবইতো কম্পিউটারে হয়। :: আমারও তাই কথারে মা, মনমরা হয়ে না থেকে কম্পিউটার শিখেনে, বলা তো যায়না কোন কাজে আসতেও পারে। কিরে যুথী কেমন আছিস? হুড়মুর করে ঘরে ঢুকে পরে শীলা, গীতা, ফেরদৌসী। ওরা আমার ক্লাশমেট। শীলা আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। ছোট বেলাতে একসাথে স্কুলে যেতাম, খেলতাম। ও ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় জুন মাসে ওর বাবা বদলী হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এখানে এসে ওকে পেয়ে আমার কিযে ভালো লেগেছে। আমার একাকিত্বের অসুখে ওই হয়ে উঠল পরম সেবক। আমাদের দুজনার বলা-নাবলা কথা সমান ভাগ করে নেই। :: বলছিলাম যুথী ঘরে বসে থাকে মনমরা হয়ে, কোথাও গিয়ে কম্পিউটারটা শিখে নিতে। ওদের চা-নাস্তা দিতে দিতে মা বললেন। ্#৬১৬৫৬; আরে কাকি আমরাওতো একথা বলতেই এসেছি। গীতা আর ফেরদৌসীও যাবে আমার সাথে। যদি যুথী যায় চারজন মিলে খুব মজা হবে। আমি রাজি হয়ে যাই। ্#৬১৬৫৬; কিরে এমন পেঁচামুখী হয়ে বসে আছিস কেন? তোর এমন চেহারাটা দেখতে মোটেও ভালনা। : তুইতো জানিস সব কিছু। আমার ভালো লাগেনা। ্#৬১৬৫৬; বনিকি আবারও চেয়েছে। : হ্যা। ্#৬১৬৫৬; আমার কিন্তু কেমন কেমন যেন লাগছে। : কেমন? ্#৬১৬৫৬; এই ধর, সে তোকে ভালবাসে, আছে অনেক দুরে, ফোনে কথা হয়। তুই মাঝে মাঝে ছবি পাঠাস, ঠিক আছে। কিন্তু সে তোর নগ্ন ছবি চাইবে কেন? এটাতো কোন রুচিকর ব্যাপারনা। :কিন্তু দেশে থাকতে ওতো কোনদিন আমার শরীর ছুয়ে দেখেনি। ্#৬১৬৫৬; এটাইতো চিন্তার বিষয়। ইউরোপ খুবই উন্নত যায়গা আর ফরাসী শিল্পকর্মের জন্য বিখ্যাত। সেখানে সব কিছুই খোলামেলা। কোন জড়তা নেই। কোন রাখডাক নেই। মানুষের বদলে যেতে কত দিন? : তোরা এভাবে বলিসনা, এমনিতেই আমার মনটা ভালো না তার মধ্যে আবার এসব বলছিস। ্#৬১৬৫৬; থাক তোর আর এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা, ওকে বলে দিস হবেনা। স্টুডিওতে এই ছবি যদি কপি করে রাখে কেমন কেলেঙ্কারী হবে ভেবে দেখেছিস? : আমি কিছু ভাবতে পারছিনা। আমার মনে পরে যায় ৪বছর আগের কিছু স্মৃতি মনির, খুলি খিড়কি শীতের রাত। ভেতরে একটা শিহরণ দোলা দিয়ে যায়। আচ্ছা মনির এখন কোথায় আছে কি করছে? শুনেছিলাম পলিটেকনিকে ভর্তি হয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেছে। তারপর মারামারি। একটা খুনের কেসের আসামিও হয়েছে। ভাইয়া রেডি হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ডেকে জিজ্ঞেস করি : ভাইয়া মনির ভাই এখন কোথায়রে? - আরে ওই হারামজাদার কথা বলিসনা। সে এখন টিএসসির ক্যান্টিনে ওয়েটারের চাকুরী করে। বাপ বিদেশে থেকে ছেলের কোন খোজ রাখেনি, আর মাকেতো কোন পাত্তাই দেয়নি। মারামারি করে লেখাপড়াটাও খেয়েছে। ভেতরে কি একটা কষ্ট বোধ কাজ করছে? নাকি অন্য কিছু? গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। ৫. আমরা চার বান্ধবী মিলে অদিতি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে যাই। প্রতিদিন কলেজে যাওয়ার সময় এই প্রতিষ্ঠানটা দেখা হয়। কিন্তু কখনো ভেতরে যাবার বা জানার উৎসাহ হয়নি। ভেজানো দরজা ঠেলে জিজ্ঞেস করি : আসতে পারি? কতক্ষন তাকিয়ে থেকে ২৫/৩০বছর বয়সী একটা যুবক ছেলে উত্তর দেয় - এসো আমার খুব হাসি পায় এই এসো বলতে এতক্ষন সময় লাগে? প্রয়োজনীয় কথাবার্তা শেষে আমাদের সবাইকে কম্পিউটারে বসিয়ে ক্লাশ শুরু করে দেয়। আমি এমন যান্ত্রিক মানুষ দেখিনি। প্রথম দিনই ক্লাশ শুরু? আর ছেলেটার নামটাও বেশ "সূর্য"। সময়টা বেশ ভালোই কাটতে লাগলো। আমরা সূর্যদার সাথে বেশ সচ্ছন্দই বোধ করছি। তার মধ্যে পুরুষ সুলভ মনোভাব দেখিনি। দেখিনি পূর্ণ যৌবনা মেয়েদের প্রতি লোভাতুর দৃষ্টি। বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে তিনি আমাদের শেখাতে লাগলেন। সূর্যদা খুব ভালো কবিতা লিখতে পারতেন। তার একটা কবিতায় লিখেছেন ------------ তোমাতে জন্মাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমার, স্বপ্ন কথা দাও তুমি হবে শুধু আমার। মাঝে মাঝে লুকিয়ে কম্পিউটার থেকে তার কবিতা খাতায় লিখে নিতাম। খুব ভালো লাগতো। মেয়েলী কৌতুহল বশে আসে না। একদিন জিজ্ঞেস করলাম এই স্বপ্নটা কে? - কোন স্বপ্নটা কে? : ঐ যে স্বপ্ন কথা দাও তুমি হবে শুধু আমার। - তার মানে তুমি আমার কবিতাগুলো দেখেছো। জানিয়ে দেখলেই পারতে। : আসলে ফোল্ডার ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই পেয়ে গেছি। - স্বপ্ন নামে কারো অস্তিত্বই নেই। এ হলো আমার মনের আকাঙ্খা। আমার জীবনে এমন কেউ আসবে যাকে নিয়ে পূর্ণিমা রাতে ছাদে বসে কবিতা শোনাব। যে আমায় গান শোনাবে। জড়িয়ে রাখবে মধুর আবেশে। ্#৬১৬৫৬; এমন কেউ কি আসেনি এখনও? শীলার প্রশ্ন। - একজনকে দেখেছি, কিন্তু মনে হয় আমার মনের গভীরে থাকা আকাঙ্খাটা মনেই চাপা থেকে যাবে। : বলে দিলেই তো পারেন। - জীবনটা কি এতই সরল? চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? ্#৬১৬৫৬; চেষ্টা করতে তো দোষের কিছু নেই। : হ্যা তাইতো। - ঠিক আছে বলবো কোন এক সময়। এখন কাজ করো। আমাদের কথা আর এগোয়না। একদিন ফোনে বনির সাথে আমার কথা হয়। শীলা সামনেই ছিল। ফোনটা নিয়ে ও বলল "বনি ভাইয়া আপনার মাথা ঠিক আছেতো? এটাতো ইউরোপ নয়, একটা মেয়ে দিব্যি তার নগ্ন শরীরের ছবি তুলে পাঠাবে। আপনি অনেক বদলে গেছেন। তা ওকে ভুলে গেলেইতো পারেন।" আমার চোখ বেয়ে শুধু দুফোটা লোনা জল গাল বেয়ে নিচে নেমে যায়। ৬. ্#৬১৬৫৬; যুথী চল কোথা থেকে ঘুরে আসি। রূপগঞ্জের জিন্দায় একটা পার্ক হয়েছে, খুব সুন্দর তোর ভালো লাগবে। : ঠিক আছে যাবো। আমি সম্মতি দিলাম। ্#৬১৬৫৬; সূর্যদাকে সংগে নিলে কেমন হয়? : যাবে নাকি? ্#৬১৬৫৬; বলে দেখি। পরদিন আমরা সবাই চললাম জিন্দা পার্কে রিকসা করে। সবাই সবার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে উঠেছে, কিন্তু আমরা দু কপালপোড়া সাথী হলাম। সূর্যদার কথা বলছি। কেমন হাস্যকর ব্যপার বলেকিনা, "চলো আমরা প্রঙ্ িপ্রেমিক-প্রেমিকা হই"। - যুথী তুমি আমার স্বপ্ন হবে? : হঠাৎ চমকে উঠি। আবার জানতে চাই, কি বললেন। - তুমি আমার স্বপ্ন হবে? আমি কি বলবো ভাবতে পারছিলাম না। - আমি কি তোমার হাতটা একটু ছুয়ে দেখবো? আমি আমার হাতটা এগিয়ে দেই মন্ত্রমুদ্ধের মতো। সারাটা পথ আমার হাতটা সুর্য ওর দুহাতে চেপে ধরেছিল। সেখানে কোন কলুষতা ছিলনা। ছিল ভবিষ্যৎ স্বপ্নে বিভোর এক সৎ যুবকের আহবান। মাঝে মাঝে আমি ওর দিকে তাকাতাম, চোখে চোখ পরা মাত্রই সুর্য ওর চোখ নামিয়ে নিতো। ওর চোখে আমি স্বপ্ন দেখেছি। মনে হলো সেই স্বপ্নে আমিও আছি। সন্ধায় আমরা ফিরে এলাম। কিন্তু আমার মনে হতে লাগলো আমার কি যেন হারিয়ে গেছে, তবুও সেই হারানোটা আমাকে ব্যথিত করলনা। বরং মনে হতে লাগলো আমার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। আমরা নিয়মিত ঘুরতে যাই। ফোনে কথা বলি। সুর্য আমাকে কবিতা লিখে পাঠায়। ওর আবৃত্তির গলাটা খুব চমৎকার। এতো ভালো লাগার মাঝেও আমার মনে একটুকরো মেঘ জমে থাকে। সেই মেঘটা বৃষ্টি হয়ে ঝড়েও পরেনা আবার মাথার উপর থেকে সরেও যায়না। অনেকবার ভেবেছি সুর্যকে আমার সব বলব। কিন্তু বলা হয়না। আমার এই পর্যন্ত জীবনে যদি ভালো কিছু পেয়ে থাকি তা হলো সূর্য। আমাদের জীবন এগিয়ে যায়। সময় বয়ে চলে তার আবহমান ধারায়। :: মারে বনি তোকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। ও কিছুদিনের মধ্যেই দেশে আসছে। তোর মতামত আছেতো? মা আমার মাথায় নারকেল তেল মাখাতে মাখাতে বলে। কিছুদিন আগে হলে খুশিতে মনটা ভরে যেত। কিন্তু আজ আমার ভেতরে একটা হাহাকার শুধু বেজে যায়। আমার কিছুই বলা হয়না। আমার চুপ করে থাকাটা মা'র কাছে সম্মতিই মনে হয়। কারন তিনি এর পরে আর কিছুই জানতে চাননি। ৭. আমি আজ পাহাড় দেখতে এসেছি, বন-বনানীর সীমাহীন সবুজতা। সামনে বিশাল সমুদ্র। সমুদ্রের ঢেউ কুলে আছড়ে পরছে। আবার নেমেও যাচ্ছে, ঠিক আমার জীবনটার মতো। সূর্যকে নিয়ে এসেছি। ও আসতে চায়নি, একরকম জোর করেই নিয়ে এলাম। বলে কিনা অবিবাহিত দুজন যুবক-যুবতি এতো দুরের পথ যাবে যেখানে দিনে দিনে ফেরা যাবেনা, এটা ভালো দেখায়না। আমি শুনে ভীষন হেসেছি। আজ আমি মুক্ত। আমার কোন বাধা নেই। মুক্ত সুতোকাটা ঘুড়ির মতো আকাশে ভেসে যাব, আর দেখবো আমার সূর্যকে। আজ সূর্য ডোবার দিন। একটা রিকশা সারা দিনের জন্য ভাড়া করি। কঙ্বাজার থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত যাব। কিছু বাড়ীঘর ডানে রেখে এগিয়ে গেলেই সাগরের পাড় ঘেষে চলে গেছে ম্যারিন ড্রাইভ রোডটা। একপাশে পাহাড়, অন্য পাশে সমুদ্র। মাঝে মাঝেই রিকসা থামিয়ে আমরা নেমে হেটে যাচ্ছিলাম সমুদ্রের জল ছুয়ে। দুপুরের দিকে হিমছড়ি পৌছালাম। ঝরণার দিকে হাটা দিলাম, আওয়াজ পাচ্ছি, কিন্তু দেখা যাচ্ছেনা। আরো ভেতরে চলে গেলাম। অবশেষে দেখলাম পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনাটা। এখানে কপোত কপোতীরা অসীম উল্লাসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে পাহাড়ী ঝরনার ঘোলাটে পানিতে গোসল করছে। ফিরে আসি সেখান থেকে। হোটেলে ফিরে এলে সূর্য গম্ভীর মুখে বসে রইল। : কি ব্যপার এমন করে বসে আছো কেন? - দুজন এক কামড়ায় থাকবো? : খিলখিলিয়ে হেসে বললাম তাতে দোষের কি হলো? - আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ঠোটে চুমু খাই। : আমার টুনটুনি পাখি রে। এতো লজ্জা কেন? তুমি না আমাকে তোমার স্বপ্ন বানাবে? - কিন্তু এভাবে নয় নিশ্চয়। : আজ পূর্ণিমা। আজ কিন্তু তোমার কবিতা শুনব। আমি ওর পিছনে বসে ওর মাথার উপর আমার চুল ছড়িয়ে, জড়িয়ে বসে থাকি। - আমার কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে বমি হবে। : কেন আবার কি হলো? - শরীরটা ধরে দেখোতো জ্বর কিনা? : ওর শরীরের তাপমাত্রা আসলেই বেড়ে গেছে। দর দর করে ঘামছে। আমি হেসে উঠি। সামনের চেয়ারটায় বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি সূর্যর দিকে। দুটো নিষ্পাপ চোখ আমাকে ভেতর থেকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছিল। কিছুক্ষন পর ও স্বাভাবিক হয়। আমরা দুজন দুিট খাটে শুয়ে পরি। কিন্তু দুজনের কেউ ঘুমাতে পারছিনা। রাত ৩টার দিকে বললাম : সূর্য ঘুমিয়েছ? - না, তুমিও ঘুমাওনি? : ঘুম আসছেনা। - আমার কেমন যেন অস্থির লাগছে। : সতিত্ব হারানোর ভয়ে? - দুর বোকা পুরুষের আবার এ ভয় কিসের? আমি উঠে ওর বিছানায় চলে যাই। একে একে খুলে যায় পুরোনো দালানের পলেস্তারা। খোলস বদলে বেরিয়ে আসে নতুন সাপ। পৃথিবীর আদিম মানুষের মতো বস্ত্রহীন দুটো দেহ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। পুরো একটি স্বর্গ নেমে আসে কঙ্বাজারের কলাতলী রোডের ছোট একটি হোটেলের তারচেয়ে ছোট একটি কামড়ায়। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম ৪টা ২০ মিনিট। বিছানা থেকে দুজনের কেউ উঠতে পারছিলাম না। রাজ্যের ক্লান্তি এসে জমাহয় দুজনার দেহে। সিলিং ফ্যানটা তার পুরো ক্ষমতায় ঘুরে যায়। তার মাঝেও সর্গের সুখ শরীরে ঘাম হয়ে ঝরে যায়। মনে শুধু প্রশ্ন জাগে এমন প্রাণবন্ত একজন পুরুষ মানুষ কিভাবে নিজের মাঝে গুটিয়ে থাকে? ৮. কঙ্বাজার থেকে ফিরে আসলে মা জিজ্ঞেস করে- :: কোথায় গিয়েছিলি? এই প্রথম আমি মার কাছে মিথ্যে বললাম- : বান্ধবীর বাড়ী। কলেজে একসাথে পড়ে। ওর গায়ে হলুদ ছিল। :: বলে গেলেইতো পারতি। আমি কি সূর্যর কাছে যাব আজ? কেমন যেন একটা লজ্জা লজ্জা লাগছিল। আমি ওর চোখের দিকে তাকাবো কিভাবে? আমার ভাবনায় ছেদ পরে একটি সালাম দেয়ার আওয়াজে। ঃ আস্সালামু আলাইকুম, কাকি কেমন আছেন? বনি মা ও বাবার পা ছু'য়ে সালাম করে। আমার বুকের ভিতরটা আবার মোচড় দিয়ে ওঠে। চমক ভাঙ্গে বনির কথায়। ঃ কেমন আছো যুথী। বনি কখনো আমাকে তুমি করে বলেনি। খুব অবাক হই। পরের ঘটনাগুলো এতো দ্রুত ঘটে যায় আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনা। পরদিন বনির মা-বাবাসহ আমাদের বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন আসেন। আজ আমার বিয়ে। আমার চোখদুটোয় শুধু বান বয়ে যায় কিছুই বলা হয়না। মাকে শুধু বলি ু : আমি বনিকে বিয়ে করবনা। :: তুইতো আগে কিছু বলিসনি। তাছাড়া বনির সাথে প্রায়ই তোর কথা হতো আমরাতো ভেবেছি দুজন দুজনকে পছন্দ করিস। : আগে করতাম মা, এখন না। :: এমন মান অভিমান থাকতেই পারে। রাতে ফুল দিয়ে সাজানো সুন্দর একটা বিছানায় আমাকে আর বনিকে থাকতে দেয়া হয়। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। মাদকাসক্তের ন্যায় বনির হাতের পুতুল হয়ে গেলাম। পরদিন বনি জানালো আমাদের পুরো রাতটিকে সে ধারণ করে রেখেছে। আমার চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে গেছে। নিজেকে বড্ড কচুপাতা মনে হচ্ছিল, কোন ভাবেই জল ধরে রাখতে পারিনা। সপ্তাহ খানিক এভাবে ঘোরের মধ্যেই কেটে গেল। মাকে সব খুলে বলি। মা মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন। :: তুই আগে বলিসনি কেন? : তোমরা বলার সুযোগ দাওনিতো। :: মা যা হয়েছে থাক আর অন্য কিছু চিন্তা করিসনা। মার এ কথাটা শুধু শোনলাম। কি করে একজন বিকৃতমস্তিস্কের মানুষের সাথে আমার সারাটা জীবন কাটাবো। অবশ্য খুব বেশীদিন কষ্ট হলোনা। বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। মরে গিয়ে কি তিনি নিজে বেঁচে গেলেন না আমাকে বাঁচিয়ে গেলেন। আমি বনিকে ডিভোর্স দেই। বনির সাথে আমার বিয়ের স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র ৭দিন। চুপচাপ ঘরে বসে থাকি। ফোনটাও বন্ধ থাকে। শীলা মাঝে মাঝে আসে। আর কারো সাথে যোগাযোগ হয়না। ((অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। ৪টা প্যারা লিখলামনা। অবশ্য এতে গল্প পড়ায় কোন ছেদ পড়বেনা। এই গল্পটা "বসন্তের কোকিল" এর সিক্যুয়াল ওটা পড়ে নিলে বুঝতে কোন অসুবিধা হবেনা)) ৯. আজ আমার একটা মেয়ে হয়েছে। সুর্য মেয়েটাকে পেয়ে যেন সবকিছু ভুলে যায়। ওর নাম রেখেছে "পুষ্প"। মেয়েটা অবিকল আমার মতো হয়েছে। মা নাতনির জন্য ছোট ছোট কাথা সেলাই করে নিয়ে আসেন। আমরা সুখেই আছি। সূর্যকে বলেছিলাম আমার বাবার বাড়ীর কারো সাথে যোগাযোগ না করতে। সূর্য কখনো আমার অতিত জানতে চায়নি। কিন্তু বিধাতার গণিত বোঝার ক্ষমতা আমার মতো এই ক্ষুদ্র মানুষের নেই। একদিন আমার মোবাইলে একটা ম্যাসেজ এলো। ফেইসবুকের একটা আইডি এবং পাসওয়ার্ড। ঘরে সুর্যর একটা ল্যাপটপ ছিল। সুর্য ট্রেনিং সেন্টারে গেলে আমি গোপনে ফেইসবুকে ঢুকি। আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলি। সেখানে আমার সমস্ত ইতিহাস জলজ্যান্ত প্রমান হয়ে আমায় মনে করিয়ে দেয় সেই অষ্টম শ্রেণীর সামসুন্নাহার যুথী, মনির, খুলি খিড়কি, আমার একসময়ের স্বামী বনি। সব কিছু সেখানে রয়েছে। আমি কিবোর্ডের সাথে যুদ্ধ করে সেগুলো মুছে ফেলতে বৃথাই চেষ্টা করি। বনি আমাকে শুধু ইউজার পাসওয়ার্ড দিয়েছে, এডমিনিস্ট্রেটর পাসওয়ার্ডতো আমি জানিনা। বনি ফোন করে, তার সাথে আমার কথা হয় কথা বলতে বাধ্য হই। তার সাথে হাসতে হয়। আমি ক্রমাগত মৃত্যু কামনা করতে থাকি। মনে পরে যায় আমি মা, আমার একটি ফুটফুটে মেয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে সূর্যর কাছ থেকে দুরে সরে যাই। অকারণে সূর্যর সাথে খিটিমিটি লেগেই থাকে। আমার শুধু মনে হয় আমি সূর্য নামের একটা দেবতাকে ঠকিয়েছি। জীবন দিয়েও এর প্রায়শ্চিত্ত হবেনা। প্রায়ই আমি মার কাছে এসে থাকি। সারাদিন ভাইয়া বাড়ি থাকেননা। আমি আমার ঘরে বন্দি। আর ও ঘরে মা সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার জন্য দোয়া করেন। অনেকদিন পর সুর্য আমাকে ফোন করে। আমি ভেতরে ভেতরে খুশিতে জ্বলে উঠি, কিন্তু ওর কথার জবাব দেয়ার ধরনে সেটা বোঝা যায়না। সুর্য আমাকে ও মেয়েটাকে নিয়ে বৈশাখী মেলায় যাবে। আমরা প্রতিবছরই যাই। কিন্তু এবার তাচ্ছিল্যের সাথে সূর্যকে না করে দেই। আমার ভেতরটা সূর্যের আগুনে পুড়ে যায়। ১০. আজ ১লা বৈশাখ ভাইয়ার কাছ থেকে মনিরের মোবাইল নম্বরটা নিয়েছি। মনিরকে ফোন করে জানিয়ে দেই আমি আজ ওর সাথে ঘুরতে যাব। মনির খুশি মনে জানায় সে তৈরি থাকবে। মাকে বলে সেই ভোর বেলাতেই বেরিয়ে যাই। আমি জানি সূর্য আসবে। ও কখনও কাউকে দেয়া কথা পালন করে নি এমনটা আমি দেখিনি। আমি সকালেই টিএসসির বাইরে উচু বেদীটার উপরে মনিরকে নিয়ে বসে আছি। আমি জানি সূর্য মেয়েটাকে নিয়ে যাবে ভার্সিটির আমতলার খেলাঘরের শিশুদের অনুষ্ঠানে। আমি আমার মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। এবার মনিরের হাত ধরে ওর সামনে দিয়ে যেতে হবে। যেন ও বুঝে আমি ওকে দেখিনি। পরিকল্পনা মতো সব হয়। সুর্যকে রাজুর পদতলে পাথর বানিয়ে আমি মনিরকে খুব আবেশে জড়িয়ে ধরে চলে যাই। সুর্য দাড়িয়ে আমাকে দেখে। আমি হাটতে হাটতে দোয়েল চত্বরের দিকে আগাই। : মনির আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ তুমি ফিরে যাও। মনির অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মানে। : মানে তুমি আর কখনো আমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করবেনা। বললেই হলো? : দেখো তুমি বাড়াবাড়ি করলে আমি চিৎকার করব। আমি তোমাকে চিনিনা। আর আজ এই মানুষের বন্যায় যদি -- । মনিরকে আর কিছু বোঝাতে হয়না। ও ফিরে চলে যায়। মনির কিছুই বুঝতে পারেনা। যেমন আমি বুঝতে পারিনি আমার সেই ১৩বছর বয়সে মনিরের হাতে হারানো সতিত্বের কথা। (সংক্ষেপিত)
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free